ময়নামতির ইতিহাস

বঙ্গদেশে যেসব এলাকায় প্রাচীনকালে সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল তার মধ্যে কুমিল্লার ময়নামতি অন্যতম। এখানে আবিষ্কৃত প্রস্তর যুগে তৈরি হাত কুড়াল, বাটালি প্রভৃতি থেকে অনুমান করা হয়, প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৩ হাজার অব্দের আগে এ এলাকায় বসতি গড়ে উঠেছিল। ময়নামতি পাহাড়ি এলাকাটি উত্তর দক্ষিণে লম্বায় ১৭ কিলোমিটার এবং প্রস্থে সর্বোচ্চ ৪.৫ কিলোমিটার আবার কোথাও তার চেয়েও কম। এর উত্তর প্রান্তে রানী ময়নামতির পাহার এবং দক্ষিণপ্রান্তে লালমাই পাহাড় অবস্থিত। মধ্যবর্তী অঞ্চলটি ৬০০-১০০০ খ্রীঃ সময়কালে বঙ্গের শিক্ষা সংস্কৃতির প্রান কেন্দ্র ও রাজধানী নগর ছিল।

ময়নামতির প্রাচীন নাম
পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক গ্রন্থ থেকে জানা যায়- ময়নামতি-লালমাই পাহাড়ী অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল দেবপর্বত, এই শৈলশ্রেনীর পশ্চিমে ছিল ক্ষীরোদা নামক নদী। দেবপর্বত ছিল পূর্ব ভারতের বৌদ্ধ শাস্ত্র ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র। প্রত্ন নিদর্শন থেকে দেবপর্বতে পট্টিকেরা, জয়কর্মান্তবসাক প্রভৃতি নামে রাজ্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আনুমানিক দশম শতাব্দীর চন্দ্র বংশীয় রাজা মানিক চন্দ্রের স্ত্রী- রানী ময়নামতির নামানুসারে অত্র অঞ্চলের নাম হয় ময়নামতি।

ময়নামতির শাসনাধীন রাজ বংশ
লালমাই-ময়নামতি প্রাচীন বাংলার সমতট এর অংশ ছিল। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস ও দেশি বিদেশি সাহিত্য থেকে সমতট অঞ্চল শাসনকারী বেশ কয়েকটি রাজবংশের নাম জানা যায়, যার অন্যতম হচ্ছে - গুপ্ত বংশ (৩২০-৫৫০ খ্রীঃ), গোপচন্দ্র বংশ, ভদ্র বংশ, নাথ বংশ, খড়গ বংশ (৬২৫-৭০৫), রাত বংশ (৬৪০-৬৭০), দেব বংশ (৭২০-৮০০), চন্দ্র বংশ (৮৬৫-১০৫৫), পাল বংশ(৭৫৬-১১৬২), বর্মণ বংশ (১০৫৫-১১৪৫), সেন বংশ (১০৯৭-১২৫০ খ্রীঃ)।
১৩ শতকের শেষ দিকে বঙ্গের সমতট ও হরিকেল জনপদের সাথে এ অঞ্চলও মুসলিম শাসনের অধীনে আসে। পরবর্তী শতকগুলোতে এ অঞ্চল ত্রিপুরা রাজাদের অধীনে শাসিত হয়। ইংরেজ শাসনামলে ১৭৬৫ সালে এটি বৃটিশ ভারতের অধিভুক্ত হয় ও ১৭৯০ সালে ত্রিপুরা জেলা গঠিত হয়। পাকিস্তান আমলে ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা জেলা নামান্তর করা হয়।

ময়নামতি রাজ্যের বিলুপ্তি
১১ শতকে সমতটের রাজধানী বিক্রমপুরে স্থাপনের পর থেকে ময়নামতি অঞ্চলের গুরুত্ব কমতে থাকে। ১২ শতকে হিন্দু সেন রাজবংশের উত্থান এবং ১৩ শতকে মুসলিম অভিযানের পর থেকে নিরাপত্তার অভাবে ময়নামতির জনগন এলাকা ছাড়তে থাকে, এমনকি দেশ ত্যাগ করে আরাকান, কামরূপ, তিব্বত, নেপাল, উড়িষ্যা প্রভৃতি অঞ্চলের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। এভাবে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যেই ময়নামতি রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। অযত্ন অবহেলায় বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মীয় স্থাপনাগুলো এক সময় লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। কালে ক্রমে এই সমৃদ্ধ জনপদ লুপ্ত হয়ে মাটি চাপা পড়ে পরিণত হয় বন-জঙ্গলে।

ময়নামতির প্রত্নতাত্ত্বিক আবিস্কার
অতঃপর দীর্ঘ কয়েক শতক পর বৃটিশ শাসনামলে ১৮৭৫ সালে পাহাড়গুলির মধ্য দিয়ে পুরোনো রাস্তা সংস্কার কালে শ্রমিকরা একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মঠের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৩৯-১৯৪৫),  ময়নামতি পাহাড়ি অঞ্চলে সেনা শিবির স্থাপনকালে কয়েকটি বিহার ও মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দৃষ্টিগুচর হয়। ব্রিটিশ তত্ত্বাবধানে ১৯৫৫ সালে ময়নামতির প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু হলে শতদিক বৌদ্ধ-হিন্দু স্থাপনাসহ তৎকালীন বহু প্রত্ন নিদর্শন উদ্ঘাটিত হয়।

ময়নামতির প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
খননে আবিস্কৃত শতাধিক স্থাপনার মধ্যে বিশেষ বিশেষ প্রত্ন নিদর্শনগুলো হচ্ছে - ভবদেব বিহার, আনন্দ বিহার, রূপবান মুড়া, কুটিলা মুড়া প্রভৃতি।

জনশ্রুতি
ময়নামতির ঐতিহাসিক নামকরণের পশ্চাতে কিছু জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে। সেই সমতট শাসনামলে রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ছিল রাজা মানিক চন্দ্র। ময়নামতি ছিল চন্দ্রবংশের রাজা মানিক চাঁদের স্ত্রী।ঐতিহাসিকদের মতে, রাণী ময়নামতির নামানুসারে এই অনুচ্চ পাহাড়ী এলাকার নাম রাখা হয় ময়নামতি।
ময়নামতি ছোটকাল থেকে ছিল যেমনি রূপবতী, তেমনি গুণবতী। যুগের প্রচলানুসারে ময়নামতি শিষ্যত্ব গ্রহণ করে গুরুর কাছ থেকে জ্যোতির্বিদ্যা ও যোগসাধনা শিখতে লাগল। বহুদিন চর্চার পর সে এমনই জ্ঞান লাভ করল যে, মানুষের ভবিষ্যত বলতে পারত। একদিন ইচ্ছে হল তার নিজের ভবিষ্যত দেখার। গণনা করে নিজের জীবনে দেখল ভীষন এক অমঙ্গলের চিহ্ন। সে এক পুত্রসন্তান লাভ করবে ঠিকই, কিন্তু সে পুত্র ১৮ বছর বয়সেই মারা যাবে। ভীষণ দুচিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ল ময়নামতি। ছেলেকে বাচাঁতে আবার যোগ সাধনা শুরু করল ময়নামতি। দেবতাকে তুষ্ট করে ছেলেকে বাঁচাতে সক্ষম হলো ময়নামতি। কিন্তু দেবতার শর্ত হল ১৮ বছর বয়স হলেই ছেলেকে সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস করতে হবে। যথাসময়ে ময়নামতি এক পুত্র সন্তান জন্ম দিল, রাজা মানিক চাঁদও ছেলেকে পেয়ে সন্তুষ্ট। অনেক সাধ করে তিনি ছেলেন নাম রাখলেন গোপীচাঁদ। একটু বড় হয়ে উঠতেই খুব ধুমধাম করে গোপীর বিয়ে দেয়া হয় হরিচন্দ্র রাজার (বর্তমানে ঢাকার সাভার) দুই কন্যা অদুনা আর পদুনার সাথে। গোপী বয়স ১৮ বছরে পদার্পন করলে সেই শর্ত ময়নামতিকে উদ্বিগ্ন করে তোলে, এবং ছেলেকে সন্ন্যাস বেশে বনে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। মায়ের নির্দেশ পালন করার জন্য গোপী প্রস্তুত হলে তার স্ত্রীদ্বয় চরম আপত্তি জানায়, তারা কিছুতেই গোপীকে বনবাসে পাঠাতে রাজী হয় না। তারা সন্দেহ প্রবন হয়ে গোপীর মাতাকে অসতী বলে কুৎসা রটাতে লাগল। রাজা মানিকচাঁদ সতীত্ব প্রমাণের জন্য ময়নামতিকে ফুটন্ত তেলের মধ্যে নিক্ষেপ করলে রানী সুস্থভাবে ফিরে আসে। ভুল ভাঙে রাজা ও তার ছেলে গোপীর, স্ত্রীদ্বয় অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায় রানীর কাছে। গোপী মায়ের কথামত সানন্দে তপস্যায় চলে যায় অরন্যে। অনেক বছর পর গোপীচাঁদ ফিরে এলে, রাজ্যজুড়ে আবার আনন্দ জেগে উঠে।

মন্তব্যসমূহ

  1. এই তথ্যের রেফারেন্স দিতে পারবেন কি?

    উত্তরমুছুন
  2. দীনেশ চন্দ্র সেনের বৃহৎ বঙ্গ পড়ে দেখুন।

    উত্তরমুছুন
  3. ময়না তদন্ত শব্দটির উৎপত্তি কী এখান থেকেই?

    উত্তরমুছুন
  4. তাহলে ত্রিপুরার সন্তান শচিন দেব বর্মন এর সত চাচা রাজা মানিক চন্দ্র বাহাদুর কে?

    উত্তরমুছুন
  5. ভুঁয়া কাহিনি সত্যের লেশ নাই মনে হচ্ছে।

    উত্তরমুছুন
  6. ময়নামতি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য কোথায় পাবো বলতে পারেন?

    উত্তরমুছুন
  7. ময়নামতি সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা হলো

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন