ভারত ভ্রমন

বিশাল ভূখন্ডের ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বৈচিত্রপূর্ণ ও ভিন্নতর হওয়ায় অনেকে বলে থাকেন - যা আছে বিশ্বে তা আছে ভারতে। আসুন সংক্ষেপে জেনে নিই ভারত ভ্রমনের কিছু তথ্য। ভারতের পশ্চিম ভাগে রাজস্থানে রয়েছে থর মরুভূমি, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বরফে ঢাকা সিকিম ও অরুনাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশে বিশ্বের সপ্তাচার্যের একটি তাজমহল, মহারাষ্ট্র প্রদেশে পাথুরে পাহার কেটে নির্মিত গুহা মন্দির যা আধুনিক বিশ্বেও বিরল নির্মান। সারা ভারতে রেল যোগাযোগ ভাল থাকায় কোলকাতা থেকে যে কোন প্রদেশে আপনি ট্রেনে যাতায়ত পারেন; তাছাড়া ইচ্ছে করলে প্লেনেও যেতে পারেন। আসুন প্রদেশ অনুসারে ভারতের পর্যটন স্থান সম্পর্কে জেনে নেই।

উত্তর প্রদেশ
উত্তর প্রদেশের অসংখ্য পর্যটন স্থানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-
তাজমহল - সম্রাট শাহজাহান তাঁর স্ত্রী মমতাজের মৃত্যুর পর ভালবাসার নির্দশন সরূপ (১৬৩১-১৬৫৩ সালে) আগ্রাতে নির্মান করেছিলেন এই অমর কৃতি। ২০ হাজার শ্রমিকের ২২ বছর সময় লেগেছিল এই স্মৃতি স্তম্ভ নির্মান করতে।
আগ্রা ফোর্ট - যোড়শ শতাব্দীতে সম্রাট আকবর নির্মান করেছিলেন এই দূর্গ, পরবর্তীতে তাজমহলের নির্মাতা শাহজাহানকে এই প্রাসাদেই বন্দী করে রেখেছিল তারই নিজ পুত্র আওরঙ্গজেব, এটি তাজমহল থেকে ২ কিমি দূরে।
ফতেপুর সিক্রি - ঐতিহাসিক এই শহরের দূরত্ব আগ্রা থেকে ৩৫ কিলোমিটার। রাজপুত মহারাজা সংগ্রাম সিংহ ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে ফতেহপুরে রাজধানী স্থাপন করেন। এই পরিকল্পিত শহর নির্মাণ করতে হাজার হাজার শ্রমিক ১৫ বছরব্যাপী কাজ করেছিল। সম্রাট আকবরের সৈন্যবাহিনী ছয়বার ফতেহপুর আক্রমণ করেন ব্যর্থ হন এবং সপ্তমবারের আক্রমণে ফতেহপুর দখল করেন।
আকবরের কবর - এটি সেকেন্দ্রা নামক স্থানে অবস্থিত, সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ করেন, কারুকার্য খচিত কবরটির ওপরে আল্লাহর ৯৯ নাম লেখা আছে, তাজমহল থেকে এর দূরত্ব ১৩ কিমি।

অন্যান্য পর্যটন স্থান কাশী ঘাট, বৃন্দাবন-মথুরা, অযোধ্যা, প্রয়াগ কুম্ভমেলা প্রভৃতি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগ্রার দুরত্ব প্রায় ১৪০০ কিমি; ট্রেনে সময় লাগে ১ দিন; ভাড়া ১৭০০-২০০০ রুপি।

দিল্লি
দর্শনীয় বিষয় সমূহ হল, কুতুব মিনার - ভারতের প্রথম মুসলমান শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেক ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণকাজ শুরু করেন। এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ ইটনির্মিত মিনার। লাল কেল্লা - মুঘল সম্রাট শাহজাহান কর্তৃক নির্মিত একটি দুর্গ। অন্যান্য পর্যটন বিষয় মাহাত্মা গান্ধী জাদুঘর, অক্ষরধাম মন্দির, সম্রাট হুমায়ুনের কবর, ইত্যাদি। কোলকাতা থেকে দিল্লির দূরত্ব প্রায় ১৫০০ কিমি, ভাড়া প্রায় ১৮০০-২১০০ রুপি, সময় লাগে ১৬ ঘন্টা; আর আগ্রা থেকে দিল্লির দুরত্ব ২৩১ কিমি, সময় লাগে ৯০ মিনিট।

হিমাচল
Himachal, India
 এপ্রিল থেকে জুন এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসে এখানকার আবহাওয়া ভালো থাকে। শীতকালে বেশ কয়েক স্থানে তূষারপাত হয়। এখানকার দর্শনীয় স্থান- সিমলা, কাজা, মানালী, রামপুর, সাংলা, কল্পা, সারহানা, মান্ডি, কুলু, টাবো, ডালহৌসী, রোটাং পাশ, মণিকরন ইত্যাদি। কোলকাতা থেকে হিমাচলের দূরত্ব প্রায় ১৯০০ কিমি; ট্রেনে ভাড়া ১৮০০-২১০০ রুপি; পৌছতে সময় লাগে ১ দিন।

জম্মু-কাশ্মীর
কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটন স্থান সমূহের মধ্যে জম্মু, কৈলাস কুন্ড, শ্রীনগর, কাটরা, ডাল লেক, উলার লেক, পহেলগাঁও, সোনা মার্গ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কোলকাতা থেকে জম্মুর দুরত্ব প্রায় ২০০০ কিলোমিটার। শিয়ালদাহ থেকে ট্রেনে যেতে পারেন, সময় লাগে ৪৫ ঘন্টা, ভাড়া এসি তে ১৭০০-২৭০০ রুপি ও ননএসি তে ৭০০-৯০০ রুপি। । তাছাড়া কোলকাতা-দিল্লি-জম্মু এয়ার সার্ভিস আছে।

পশ্চিমবঙ্গ
দার্জিলিঃ এখানকার এর মূল আকর্ষণ হল হিমালয়ের শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা তাছাড়াও আছে বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানা, ঘুম, রক গার্ডেন, সোনদা মনাস্ট্রি, বাতাসিয়া লুপ, মহাকাল মন্দির, পিস প্যাগোডা ইত্যাদি । যেভাবে যাবেন-কোলকাতা থেকে ট্রেনে নিউ জলপাইগুরি,এখান থেকে জিপে দার্জিলিং। কোলকাতা থেকে জলপাইগুরির দুরত্ব ৫৬৭ কিমি, সময় লাগে প্রায় ১০ ঘন্টা, ভাড়া ২৬০-১৫২০ টাকা।

পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্থান সমূহ শান্তিনিকেতন, মুর্শিদাবাদ-নবাব সিরাজদৌলার রাজধানী, মায়াপুর-গৌরাঙ্গমহাপ্রভুর জন্মস্থান, সুন্দরবন, দিঘা-সমূদ্র সৈকট প্রভৃতি।

সিকিম
জনপ্রিয় স্থান সমূহ গুরুদংমার-ফ্রজেন লেক, বাকথাং ঝর্না, ইয়মথাং, তাশি, লাচুং, থাঙ্গু, সেভেন সিসটার জলপ্রপাত, উষ্ণ প্রস্রবন ইত্যাদি।
বিদেশী পর্যটকদের সিকিম ভ্রমনের জন্য ইন্ডিয়ান মিশনের অনুমতির প্রয়োজন হয়। শিলিগুড়ি, কলকাতা ও দিল্লির সিকিম টুরিজম অফিস ১৫ দিনের জন্য এ ভিসা প্রদান করে থাকে।
সিকিমের নিকটবর্তী রেলষ্টেশন জলপাইগুড়ি। কলকাতার হাওড়া ষ্টেশন থেকে ট্রেনে জলপাইগুড়ি যেতে সময় লাগে ১০-১২ ঘন্টা, ভাড়া ৩১৫-১০৫০ রুপি, দূরত্ব ৫৬০ কিমি। জলপাইগুড়ি থেকে সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক এর দুরত্ব ১৪৮ কিমি, লোকাল জীপে ভাড়া ১২০ রুপি আর প্রাইভেট টেক্সিতে ভাড়া পড়বে প্রায় ১৫০০ রুপি।
দার্জিলিং ভ্রমন শেষে সড়ক পথেও যেতে পারেন সিকিম। সিকিম থেকে ৬ ঘন্টা বাস জার্নি করে ঘুরে আসতে পারেন ভুটান।

মহারাষ্ট্র
দর্শনীয় স্থান সমূহ অজন্তা ইলোরা গুহা মন্দির, কোনকান কোয়াস্ট সৈকত, গনপতি পুলে সমূদ্র সৈকত, টাদোবা ন্যাশনাল পার্ক, মুম্বাই সিটি প্রভৃতি। কলকাতা থেকে মহারাষ্ট্রের দুরত্ব প্রায় ১৬০০ কিমি, ভাড়া ৭০০-৫৫০০ রুপি, যেতে সময় লাগে ১ দিন ২ ঘন্টা।

রাজস্থান
যা যা দেখবেন- থর মরুভূমি, জয়পুর, নাহারগড়, জয়গড় দুর্গ, হাওয়া মহল, জয়সলমির, আজমির, উদয়পুর, মাউন্ট আবু। হাওড়া থেকে সরাসরি চলে যেতে পারেন রাজস্থানের যোধপুর, কলকাতা থেকে দুরত্ব প্রায় ১৭০০ কিমি, সময় লাগবে ২২-৩০ ঘন্টা, ভাড়া ১৫০০-২৩০০ রুপি।

পাঞ্জাব
Amritasar golden temple
অবশ্যই দেখতে ভুলবেন না অমৃতসর স্বর্ন মন্দির। দোতলা এ মন্দিরটি নির্মান কাজ শুরু হয় ১৫৭৪ সালে আর সমাপ্ত হয় ১৬০১ সালে। শিখ ধর্মের পঞ্চম গুরু অর্জুন দেব এটি নির্মান করেন। শিখ ধর্ম ও ভক্তির অন্যতম কেন্দ্র এ মন্দিরটি ধর্মীয় পবিত্র স্থান তাই এখানে বেশ কিছু নিয়ম নীতি প্রবেশ করতে হয়। এখানে মাংস খাওয়া, মদ পান বা ধূমপান কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মন্দিরে প্রবেশের পূর্বে জুতা খুলে অমৃতসরের জলে পা ধুয়ে প্রবেশ করতে হয়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাঞ্জাবের দুরত্ব প্রায় ১৮০০ কিমি, সময় লাগে প্রায় ২৮ ঘন্টা, ট্রেনে ভাড়া ৭০০-৪৫০ রুপি।

কর্নাট
দর্শনীয় বিষয় হাম্পি, গোকর্ন সৈকত, যুগ ঝর্না, কূর্গ ঝর্না, নাগাহোল ন্যাশনাল পার্ক, মুরুদেশ্বর বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিব মুর্তি উচ্চতা ১২৩ ফুট, ও এক হাজারের উপরে বিভিন্ন দূর্গ রয়েছে।

গুজরাট
যা যা দেখবেন, দ্বারকা নগরী-শ্রী কৃষ্ণের শাসনাধীন রাজ্য, ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন লোথাল ও ডোলাভিরা, সোমনাথ মন্দির ইত্যাদি।

মেঘালয়
পর্যটনের উল্লেখযোগ্য বিষয় শিলং ঝর্না, জীবন্ত শিকরের সেতু, বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল স্থান চেরাপুঞ্জি।

উড়িষ্যা
উড়িষ্যার দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য - পুরী, ভূবনেশ্বর, কটক, কোনারক, চিলকা হ্রদ, গোপালপুর, ললিতগিরি, ধবলেশ্বর ইত্যাদি। এখানকার প্রধান ভাষা ওড়িয়া কিন্তু এখানে হিন্দী, বাংলা এবং ইংরেজী ভাষাও চলে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে পুরীর দুরত্ব ৫০২ কিমি, সময় লাগে প্রায় ১০ ঘন্টা, ভাড়া ৩৫০-৯৩০ রুপি।

তামিল নাড়ু
পর্যটনের বিষয় ধর্মপুরী জলপ্রপাত, কন্যাকুমারী সমূদ্র সৈকত, চেন্নাই মেরিনা বীচ ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে তামিল নাড়ুর চেন্নাইয়ের দুরত্ব প্রায় ২২০০ কিমি, ট্রেনে ভাড়া ৭০০-৪৩০০ রুপি, সময় লাগে প্রায় ৩০ ঘন্টা।

কেরেলা
দর্শনীয় বিষয় লেক, জলপ্রপাত, সমূদ্র সৈকত, পাহাড়ী বাগান প্রভৃতি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেরালার দুরত্ব ২২০০ কিমি, সময় লাগে প্রায় ৩৫ ঘন্টা, ট্রেনে ভাড়া ৮০০-৩০০০ রুপি।

আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ
ভারতীয় ভূখন্ড থেকে জলপথে ১২৫৫ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের বুকে ৫৭২টি দ্বীপ নিয়ে এই দ্বীপপুঞ্জ। নীলাব জলরাশির মাঝে সবুজ পাহাড়ী অরণ্য, আদিম জাতিগোষ্টির মানুষজন, নানান রঙের কোরাল, রঙিনমাছ, জীবন্ত আগ্নেয়গিরি ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বন্দী সৈনিকদের স্মৃতিবিজড়িত কারাগার প্রভৃতি রোমাঞ্চকর পর্যটন আকর্ষন নিয়ে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র। এই দ্বীপপুঞ্জের মোট আয়তন ৮২৪৯ বর্গকিলোমিটার। বছরে দুইবার বর্ষা হয় এখানে । এখানকার প্রধান ভাষা হল আন্দামানিজ, বাংলা, হিন্দী, ইংরেজী, তেলেগু, নিকোবরিজ ইত্যাদি। যা যা দেখবেন- রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার, ব্যারেন আইল্যান্ড, লিটল আন্দামান, রাটল্যান্ড দ্বীপ, নীল দ্বীপ, সেলুলার জেল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের বাঙ্কার, মহাত্মা গাঁন্ধী মেরিন ন্যাশনাল পার্ক, মাড আগ্নেয়গিরি, লিমেস্টন গুহা প্রভৃতি।
ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাস আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণের সবচেয়ে ভাল সময়। যাতায়তের পথ জলপথ ও আকাশপথ। কোলকাতা-আন্দামান পথে প্রতিদিন বিমান যাতায়ত করে, সময় লাগে ২ ঘন্টা। আর কোলকাতা থেকে ৩টি জাহাজ মাসে প্রায় ৪ বার যাতায়ত করে, ভাড়া ২০০০-৭০০০ রুপী, সময় লাগে ৩ দিন।

মন্তব্যসমূহ