ইলোরা ও অজন্তা গুহা মন্দির, ভারত

ইলোরা

ভারতের দক্ষিন-পশ্চিম অঞ্চলের রাজ্য মহারাষ্ট্রের খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এটি রাজ্যের আওরঙ্গবাদ শহর থেকে ৩০ কিমি উত্তরে ও খুলদাবাদের নিকটবর্তী পর্যটন কেন্দ্র। চরনন্দ্রী পাথুরে পাহাড় কেটে এই গুহা মন্দিরসমূহ তৈরী করা হয়েছে। এটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদায় ভূষিত হয়েছে।
গ্রানাইড পাথরের এই পাহাড়ের ৩৪টি গুহার মধ্যে ১৭টি হিন্দু ধর্মের, ১২টি বৌদ্ধ ধর্মের এবং ৫টি জৈন ধর্মের মন্দির রয়েছে। ধারণা করা হয় চতুর্থ থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে কালাচুরি, চালুক্য ও রাষ্ট্রকুট রাজবংশের শাসনামলে এই মন্দিরগুলো নির্মিত হয়েছিল। এর মধ্যে খোদাইকৃত বহুতল ভবন বাসস্থান, উপাসনালয় রান্নাঘর সহ অন্যান্য কক্ষ বিদ্যমান।

এগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর গুহাটির নাম ‘কৈলাসনাথ মন্দির’। এটি একটি হিন্দু গুহা, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত, একটিমাত্র পাথরকে কেটে এটি তৈরী করা হয়েছে। এই গুহায় বহু হিন্দু দেবতা এবং পৌরাণিক মূর্তি খোদাই করা আছে। অষ্টম শতাব্দীতে রাষ্ট্রকূটদের রাজত্বকালে এই মন্দিরটি নির্মান করে হিন্দু দেবতা শিবের নামে উৎসর্গ করা হয়। মন্দিরটির মধ্যে একটি উন্মুক্ত মণ্ডপ আছে। এখানে বিশাল বিশাল হাতি ও চতুষ্কোণ স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। কৈলাসনাথ মন্দির এর উচ্চতা ২৯ মিটার ও দৈর্ঘ্য ৫০ মিটার। এটি প্রায় ২,০০,০০০ টনের পাথুরে পাহার কেটে তৈরী করা হয়েছিল, যার জন্য সময় লেগেছিল ১০০ বছর।
ভূতত্ত্ববিদদের মতে প্রাচীন আগ্নেয়গিরির উদ্গীরনের ফলে অত্র পাহাড়ী অঞ্চল বিভিন্ন শিলা স্তরে গঠিত। খুবই মজবুত পাথর হওয়ায় গুহা নির্মানসমূহ এত দীর্ঘকাল যাবৎ টিকে রয়েছে। অজন্তা গুহার ন্যায়, ইলোরা কখনো লোক চক্ষুর অন্তরালে যায়নি। বিভিন্ন লেখা ও ভ্রমণকাহিনী থেকে জানা যায়, ইলোরা নিয়মিত পরিদর্শন হত।
ইলোরা বেড়াতে গেলে এর নিকটবর্তী দৌলতাবাদ দুর্গও দেখে আসতে পারেন।

অজন্তা

অজন্তা গুহাসমূহ ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের আওরঙ্গবাদ জেলার, জলগাঁও রেলস্টেশনের কাছে, অজন্তা গ্রামের পাশেই পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত। এটি আওরঙ্গবাদ থেকে প্রায় ১০৫ কিমি উত্তরে এবং ইলোরা থেকেও প্রায় ১০৮ কিমি উত্তর-পূর্বে অবস্থিত । গভীর খাড়া গিরিখাতের পাথর কেটে খোদাই করে এই গুহাগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে । এখানে রয়েছে প্রায় ৩০টি গুহা-স্তম্ভ। গুহাসমূহ খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টীয় ৭০০ অব্দের মধ্যে নির্মান করা হয়েছিল এমনটাই বিশেষজ্ঞগনের ধারনা।
Ajanta cave

গুহাগুলোতে শিল্পীরা রীতিমত পরষ্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করে গুহার দেয়ালে ফুটিয়ে তোলেন তাঁদের শিল্পকর্ম যা মানব সভ্যতার শিল্পকলার ইতিহাসের এক অনন্য সম্পদে পরিণত হয় । ৪৮০ খ্রীস্টাব্দে সম্রাট হরিসেনার রাজত্বের অবসান হলে মন্দিরগুলো ধীরে ধীরে পরিত্যাক্ত হয় । বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে যায় এই অতুল কীর্তি । অরণ্য গ্রাস করে নেয় পুরো এলাকা। গুহাগুলো পরিণত হয় সাপ ও অন্যান্য বন্য জন্তুর আবাস স্থলে । শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে যায়। ১৮১৯ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ব্রিটিশ সেনা অফিসার জন স্মিথ জঙ্গলে বাঘ শিকার করতে গিয়ে গুহাটির সন্ধান পান । বাদুর, সাপ আর অন্যান্য ছোট বড় জন্তুর ভয় সত্ত্বেও কৌতুহলী হয়ে জন স্মিথ ভিতরে প্রবেশ করেন আর গুহার শিল্প সম্পদ দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান । এরপর এখানে শুরু হয় প্রত্নতাত্বিক অভিযান।
গুহা গুলোর সামনে রয়েছে বারান্দা । বারান্দার ছাদ ও স্তম্ভগুলো দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যে শোভিত । প্রতিটি গুহার মাঝখানে রয়েছে প্রশস্ত জায়গা বা হল । হলগুলোর চারদিকে রয়েছে বড় চারটি স্তম্ভ । ছাদ যেন ধ্বসে না পড়ে সে জন্য রয়েছে পাথরের খিলান । অজন্তায় গুহাচিত্রের জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে তা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের গুহাচিত্রের পদ্ধতির চেয়ে সম্পূর্ণ পৃথক । অজন্তা গুহার চিত্রাবলী ভারতের প্রাচীনতম মন্দিরচিত্রের অন্যতম নিদর্শন। পাহাড় কেটে কিভাবে এই মন্দিরগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল তা আজও স্থাপত্যজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক বড় বিষ্ময়। প্রতিদিন দেশ বিদেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক অজন্তার এই আচার্য নির্মান শৈলীর গুহা মন্দির দেখতে আসে।
অন্যতম বিরল গুহা চিত্রের জন্য  অজন্তা ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন