প্রত্ননগর রাজশাহী

সড়ক পথে ঢাকা থেকে রাজশাহীর দূরত্ব ২৭০ কিমি। বাসে সময় লাগে প্রায় ৭ ঘন্টা, ভাড়া ৪০০-১০০০ টাকা। এ পথে বেশ কয়েকটি বাস সার্ভিস রয়েছে। ঢাকার মহাখালী ও গাবতলী থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন সময়ে এসব বাস ছেড়ে যায়। তাছাড়া ট্রেনেও যেতে পারেন, ঢাকা থেকে নিয়মিত রাজশাহীর পথে ট্রেন চলাচল করে।

রাজশাহী শহরের আশে পাশে রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান, তার মধ্যে পুঠিয়া রাজবাড়ি, বরেন্দ্র জাদুঘর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, পদ্মার তীর, বাঘা মসজিদ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

রাজবাড়ি

রাজশাহী থেকে নাটোর যাওয়ার পথে পুঠিয়া বাস স্ট্যান্ড থেকে ১ কিমি দক্ষিনে অবস্থিত এ রাজবাড়ি। এর দূরত্ব রাজশাহী থেকে ৩২ কিমি ও নাটোর থেকে ১৮ কিমি। ১৯৫০ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির পূর্ব পর্যন্ত পুঠিয়ার জমিদারী অক্ষুন্ন ছিল। চারপাশ পাচিলে বেষ্টিত রাজবাড়ি এলাকার ভিতরে বেশ কয়েকটি সুদৃশ্য মন্দির রয়েছে, এর মধ্যে পঞ্চরত্ন গোবিন্দ মন্দির, শিব মন্দির, জগদ্ধাত্রী মন্দির উল্লেখযোগ্য। উল্লেখ্য এখানে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শিবলিঙ্গ মুর্তি বিদ্যামান। দ্বিতল বিশিষ্ট রাজবাড়ির ভবনটি বর্তমানে লস্করপুর ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।


বরেন্দ্র জাদুঘর


রাজশাহী শহরের হেতেম খাঁ-তে এ জাদুঘরটি অবস্থিত। অতীতে বৃহত্তর রাজশাহী ছিল প্রাচীন বাংলার বরেন্দ্র অঞ্চল। এ অঞ্চলের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষন ও গবেষনার উদ্দেশ্যে ১৯১০ সালে স্থাপিত হয় এ জাদুঘর। দক্ষিন এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ জাদুঘর এটি। কয়েক হাজার বছর পূর্বের সিন্ধু সভ্যতা থেকে শুরু করে, গুপ্ত রাজবংশের হিন্দু সভ্যতা, পাল রাজবংশের বৌদ্ধ সভ্যতা ও মোগল আমলের মুসলিম সভ্যতার অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন এ জাদুঘরে রয়েছে। বর্তমানে এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে।


পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার 


দেশের সর্বোবৃহত এই বৌদ্ধবিহারটি বৃহত্তর রাজশাহীর নওগাঁ জেলাস্থ বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত। কোন পাহাড় না থাকা সত্ত্বেও এলাকারটির নাম পাহাড়পুর, সম্ভবত মহাবিহারটি উচু পাহাড়াকৃতির হওয়ায় স্থানটির নাম পাহাড়পুর নামে পরিচিতি লাভ করেছে। ঐতিহাসিক গবেষকদের মতে পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব (৭৮১-৮৮১ খ্রীঃ) এ বিহার নির্মাণ করেন। এখানে প্রত্নতত্ত্ব খননে প্রাপ্ত একটি মাটির সিল থেকে জানা যায়, ধ্বংসাবশেষ এই বিহারটির নাম সোমপুর বিহার।

২৭ একর জমি নিয়ে বিহারটি ঘটিত। বিহারের বেদিতে বহু হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি ও দেয়ালে বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে। এ বিহারের ১৭৭টি কক্ষে প্রায় ৮০০ ভিক্ষুর আবাসিক ব্যাবস্থা ছিল। আয়তন বিচারে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধবিহার বলা চলে । বৌদ্ধ শাসনামলে প্রায় ৩০০ বছর ধরে এটি বৌদ্ধ সংকৃতি ও জ্ঞানচর্চার বিখ্যাত কেন্দ্র ছিল। ভারতের বিহার রাজ্যের নালন্দা মহাবিহারের মত এখানেও চীন, মালয়েশিয়া, ব্রহ্মদেশ, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে বৌদ্ধরা আসত বিদ্যাশিক্ষা ও ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে। দশম শতকে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান এ সোমপুর বিহারের আচার্য ছিলেন। কাহ্নাপা, লুইপা প্রভৃতি বৌদ্ধ পন্ডিত ও কবি কর্তৃক এখানে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন কাব্য চর্যাপদ রচিত হয়েছিল। পাহাড়পুরের সোমপুর বৌদ্ধবিহার ইউনেস্কো স্বীকৃত একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।

খননে প্রাপ্ত প্রত্ন নিদর্শনাদি বিহারের জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। জাদুঘরটি ৯টা - ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে; রবিবার পূর্ণ দিবস, সোমবার অর্ধ দিবস এবং অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনে বন্ধ থাকে।

কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা বা রাজশাহী থেকে বাসে নওগাঁ; নওগাঁ বালুডাংগা বাস টার্মিনাল হতে আবার বাসে পাহাড়পুর, তারপর রিক্সা বা ইজি বাইকে সোমপুর বিহার। নওগাঁ থেকে দূরত্ব প্রায় ৩২ কিমি, সময় লাগে দেড় ঘণ্টা, ভাড়া ৪০ টাকা।

কোথায় থাকবেনঃ নওগাঁ শহরে থাকার জন্য ভাল মানের বেশকিছু হোটেল রয়েছে, এগুলোর মধ্যে কয়েকটা -

  • হোটেল অবকাশ- এসি রুম ভাড়া ৪০০ টাকা, নন এসি ৩০০ টাকা। মোবাইল - ০১৭ ১১৫৮২১৬০।
  • হোটেল যমুনা- এটি নওগাঁ লিটন ব্রিজের পাশে অবস্থিত। ভাড়া ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা। মোবাইল - ০১৭ ১৬২৮৪০০০।
  • চিস্তিয়া - বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত। এসি রুম ভাড়া ১৮০০ থেকে ৫০০০ টাকা। নন এসি রুম ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। মোবাইল ফোন - ০১৭ ২০৫৪৪৪৪৫।
  • হোটেল আরিফ - কাপড় পট্টিতে অবস্থিত। ভাড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। মোবাইল - ০১৭ ৫৩৪২৭৬৮৫।
  • এছাড়া পাহাড়পুর সরকারি ডাক বাংলোতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে থাকতে পারেন। ভাড়া সিঙ্গেল ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা, ডাবল ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা। মোবাইল- ০১৭ ১১৩০১২৭৪।

মহাস্থানগড়


বগুড়া শহর থেকে ১৩ কিমি উত্তরে করতোয়া নদীর সন্নিকটে শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত এ প্রত্নভান্ডার মহাস্থানগড়। প্রাচীনকালে এর নাম ছিল পুণ্ড্রনগর, তারও পূর্বে পুণ্ড্রবর্ধন। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় থেকে ৫ম শতাব্দী সময়কালে এ অঞ্চলে সমৃদ্ধিশালী জনপদ ছিল। মৌর্য, গুপ্ত ও পাল যুগে ও পরবর্তীকালে হিন্দু সামন্ত রাজাদের শাসনকালে প্রদেশিক প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল এখানে। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষনায় এখানে বিভিন্ন যুগের বহু প্রাচীন নিদর্শনাদি উদ্ঘাটিত হয়েছে।

মহাস্থানগড় এর আশপাশে থাকা অসংখ্য স্থাপনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন সমূহ হলঃ বেহুলা লক্ষীন্দরের ভিটা বা গোকুল মেধ, জিয়ত কুণ্ড, ভাসু বিহার, শিলাদেবীর ঘাট, কালিদহ সাগর, বিষপত্তন ও পদ্মার বাড়ী, ভীমের জাঙ্গাল, গোবিন্দভিটা, ধোপাপুকুর, মানখালীর কুণ্ড, মাহী সাওয়ার-এর মাজার, পদ্মার বাড়ি, ভবানীপুর সতী পিঠ ইত্যাদি।

মাহী সাওয়ার-এর মাজার - প্রচলিত কাহিনী মতে, ১২০০ শতকের দিকে মহাস্থানগরের রাজা ছিলেন পরশুরাম। কথিত আছে মাছের পিঠে আরোহন করে ফকির বেশী আধ্যাত্মিক শক্তিধারী দরবেশ হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র:) এ বরেন্দ্র ভূমিতে আসেন। মাহমুদ বলখী (র:) ক্ষত্রীয় নরপতি পশুরামকে (১২০৫-১২২০) যুদ্ধে পরাজিত করে এখানে ইসলামী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার মাজারটি মহাস্থানের দক্ষিণপূর্ব কোণে অবস্থিত।

শীলাদেবীর ঘাট - কথিত কাহিনী মতে, রাজা পরশুরাম শাহ বলথী সাথে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হওয়ার পর তার কন্যা শীলাদেবী স্বীয় মর্যাদা রক্ষার্থে করতোয়া নদীতে ঝাপ দিয়ে জীবন বিসর্জন দেন। সেই স্থানটি শীলা দেবীর ঘাট নামে পরিচিত। তার স্মৃতির সম্মানার্থে এখানে প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তিতে মেলা বসে। ঐ দিন করতোয়া নদীতে হিন্দু ধর্মালম্বীদের পুণ্যস্নান অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।

জিউৎকুন্ড - সুলতান বলখীর মাজার ও জাদুঘরের মাঝামাঝি গড়ের ওপর একটি বড় কূপ আছে। কথিত আছে এ কূপের জল পান করে পরশুরামের আহত সৈন্যরা সুস্থ হয়ে যেত। সুলতান বলখী একটি চিলের মাধ্যমে এক টুকরো গরুর মাংস ওই কূপের মধ্যে ফেলে দিলে কূপের আরোগ্য ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এই কূপের জলে মৃত সৈন্যদের জীবিত করা হতো বলে এর নাম হয়েছে জিউৎকুন্ড।

বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর- বগুড়া শহর থেকে ১০কিঃমিঃ উত্তরে এবং মহাস্থানগড় থেকে ২কিঃ মিঃ দক্ষিণে গোকুল গ্রামের দক্ষিন পশ্চিম প্রান্তে অনস্থিত এই কিংবদন্তী স্থান গোকুল মেদ বা বেহুলার বাসর ঘর।

প্রচলিত লোক কথা মতে, দেবী মনসার পূজা না করায় রুষ্ট হয়ে কেড়ে নিয়েছে চাঁদ সওদাগরের ছয় পুত্র। বাকি কেবল লখিন্দর। কিন্তু তাঁকেও কেড়ে নেওয়ার সময় বেঁধে দিয়েছেন মনসা, বাসররাতই হবে লখিন্দরের জীবনের শেষ রাত। কী করবেন চাঁদ সওদাগর? অনেক ভেবে লোহা দিয়ে নির্মাণ করলেন লখিন্দরের জন্য নিশ্ছিদ্র শয়নকক্ষ। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। কোনো এক ফুটো সরু ফুটো দিয়ে ঢুকে পড়ল মনসার সাপ, এবং সেই রাতেই সাপের দংশনে লক্ষিন্দরের মৃত্যু হয়। তারপর সতী স্ত্রী বেহুলা দেবী মনসাকে পূজায় সন্তুষ্ট করে স্বামীকে জীবিত করে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।

জাদুঘর - মহাস্থানগর খননে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি এই জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। গ্রীষ্মকালে ১০টা-৬টা ও শীতকালে ৯টা-৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে, দুপুর ১টা-২টা পর্যন্ত মধ্যাহ্ন বিরতি থাকে। সোম বার অর্ধ দিবস, রবিরার ও সরকারী ছুটির দিনে পূর্ণদিবস বন্ধ থাকে। প্রবেশ ফি মাত্র ২ টাকা।

যেভাবে যাবেনঃ ঢাকার গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে গ্রীনলাইন, এসআর পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন, টিআর ট্রাভেলস, হানিফ ইন্টারপ্রাইজ প্রভৃতি এসি-ননএসি বাসে বগুড়া যেতে পারেন। যেতে সময় লাগে ৪-৬ ঘন্টা, বাস ভাড়া ৪০০-৬০০ টাকা। যোগাযোগের জন্য প্রয়োজনীয় ফোন নাম্বার - শ্যামলী পরিবহন (০২-৯০০৩৩৩১, ০২-৭৫২০৪০৫), এসআর ট্রাভেলস (০২-৮০১৩৭৯৩, ০২-৮০৬০৮৭৬), টিআর ট্রাভেলস (০১১৯১-৪৯৪৮৬৫, ০১১৯১-৪৯৪৮৬৮, গ্রীন লাইন পরিবহন (০১৭১৬৯৭৬৭৭৫, ৯০০৮৬৯৪)।

কোথায় থাকবেনঃ মহাস্থানগড়ে থাকার তেমন সুবিধা নেই, বগুড়া শহরে থাকতে পারেন এখানকার হোটেলের মধ্যে হোটেল নাজ গার্ডেন (ফোর স্টার), পর্যটন মোটেল, নর্থওয়ে মোটেল, সেঞ্চুরি মোটেল, সেফওয়ে মোটেল, মোটেল ক্যাসল এমএইচ অন্যতম। এখানে ২০০-১০০০ টাকার মধ্যে পেয়ে যাবেন বিভিন্ন মানের হোটেল।

মন্তব্যসমূহ