সোনারগাঁ - স্বর্ণ না থাকলেও প্রত্ন সম্পদে ভরপুর বাংলার এই প্রাচীন রাজধানী

সোনারগাঁও এর অবস্থান ঢাকা থেকে ২৭ কিমি পূর্বে, মোগড়াপারাস্থ ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের উত্তরপাশে। বর্তমানে এটি নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা। এখানকার উন্মুক্ত বাগান, লেক, পিকনিক স্পট আপনার অবকাশ যাপনের একটি মনোরম স্থান হতে পারে। এখানে আপনি অবকাশ বিনোদনের পাশাপাশি প্রাচীন বাংলার অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন সম্পর্কে ধারনা পেতে পারেন।

 সোনারগাঁও এর ইতিহাসঃ
১১শ - ১২শ শতকে হিন্দু সেন রাজাদের শাসনামলে বাংলার রাজধানী ছিল বিক্রমপুর। লক্ষন সেনের শাসনামলে ১২০৫ সালে বখতিয়ার খলজি বাংলা আক্রমন করলে, বাংলা নদীয়ার অংশ হারায়। পরবর্তিতে তার দুই পুত্র বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন বাংলার বাকী পূর্বাংশ শাসন করে।
১৩ শতকের শেষের দিকে সেন বংশের অবসান হয় এবং তৎকালীন বাংলার রাজা দশরথ দেব ওরফে দনৌজ রায় সোনারগাঁয়ে রাজধানী স্থাপন করেন। ১৩০২ সালে মুসলিম অভিযানে দনৌজ রায় পরাজিত হলে পূর্ব বাংলায় স্বাধীন হিন্দু রাজত্বের অবসান ঘটে।

তারপর বাহাদুর শাহ, মুবারক শাহ, ইলিয়াস শাহ সহ বিভিন্ন সুলতানের হাত বদল হয়ে বাংলা ঈশাখাঁর শাসনাধীন হয়। রাজা দশরথ দেব থেকে ঈশাখাঁ পর্যন্ত বেশীর ভাগ সময় বাংলার রাজধানী ছিল সোনারগাঁও। ঈশাখাঁর শাসনকালে (১৫৬৪-১৫৯৯) বানিজ্য নগরী সোনারগাঁও ছিল বেশ বিখ্যাত, বাণিজ্যের জন্য দেশ বিদেশ থেকে আগত বনিকদের কোলাহলে সরগরম থাকত এই নগর। সোনারগাঁয়ের তাতীদের হাতে বুঁনা মসলিন শাড়ি বিশ্বব্যাপী সুবিখ্যাত ছিল।

উল্লেখযোগ্য নিদর্শনঃ
এখানে শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর, পানাম নগর ছাড়াও এর আশে পাশে কয়েক কিমি এর মধ্যে রয়েছে সোনাবিবির মাজার, পাঁচবিবির মাজার, গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের সমাধি, রূপগঞ্জ রাজবাড়ি, পশ্চিম বঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পৈত্তিক বাড়ি, হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থভূমি বারদী লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম প্রভৃতি ঐতিহাসিক স্থাপনা।

লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনঃ
ফাউন্ডেশনের ভেতরে রয়েছে অস্ত্রসহ অশ্বারোহী মূর্তি, জয়নুল আবেদিনের অঙ্কিত গরুর গাড়ির ভাস্কর্য, আম লিচু পেয়ারা বাগান, জামদানী পল্লী, লেক ইত্যাদি। লেকে নৌকায় ভ্রমণ, বড়শিতে মাছ শিকার করে সময় কাটাতে পারেন। জাদুঘরে রয়েছে প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁও-এর অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন সহ অবাহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতির সম্ভার। সোনারগাঁও ফাউন্ডেশন শনি থেকে বুধবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত পরিদর্শনের জন্য খোলা থাকে, বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটি। কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে প্রবেশমূল্য দশ টাকা।

পানাম নগরঃ
লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন থেকে আধা কিমি উত্তর দিকে গোয়ালদী গ্রামে অবস্থিত ঐতিহাসিক এই পানাম নগর। এক সময় এই রাজধানী নগরী ছিল জমজমাট অন্তর্জাতিক এক বানিজ্য কেন্দ্র; সিংহল, জাভা, সুমাত্রা, ব্রহ্মদেশ প্রভৃতি স্থান থেকে বনিকেরা এখানে বাণিজ্যতরী নিয়ে আসত। দেশী বিদেশী মানুষের ভীড়ে রমরমা থাকত নগরীর রাস্তা ঘাট, নর্তকীর নাচ গানে মুখরিত থাকত জলসা ঘর।

১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় হিন্দু ব্যবসায়ীদের এই বসতি লুট হয়ে যায়। পরবর্তীতে বহু হিন্দু ব্যবসায়ীর দেশত্যাগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তা হীনতা প্রভৃতি কারনে পানামের বাণিজ্য কাঠামো ধ্বংস হয়ে পড়ে। এরপর আর জেগে উঠেনি পানাম। বর্তমানে এটি জনমানব শূন্য শুধু কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে।

পানাম নগরীতে ধ্বংস প্রাপ্ত উলেখযোগ্য স্থাপনা সমূহ - আবাসিক ভবন, মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, মঠ, পান্থশালা, চিত্রশালা, নাচঘর, দরবার কক্ষ, গুপ্ত পথ, বিচারালয়, পুরনো জাদুঘর, ৪০০ বছরের পুরোন টাকশাল বাড়ি প্রভৃতি। এছাড়াও নগরীর আশেপাশে ছড়িয়ে আছে ঈসা খাঁ ও তাঁর ছেলে মুসা খাঁর প্রমোদ ভবন, সোনাকান্দা দুর্গ, কদম রসুল, ফতেহ শাহের মসজিদ, পঞ্চপীরের মাজার, চিলেকোঠাসহ বহু পুরাতাত্ত্বিক স্থাপনা।

যেভাবে যাবেনঃ
ঢাকা গুলিস্তান স্টেডিয়াম থেকে স্বদেশ, বোরাক প্রভৃতি বাসে চলে যাবেন মোগড়াপাড়া তারপর রিক্সা-সিএনজিতে চলে যাবেন সোনারগাঁ জাদুঘর বা পানাম নগর।।

মন্তব্যসমূহ