বগা লেক - পাহাড়ের চুড়ায় লেক

বগা লেকের সৃষ্টি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে একটি লোককাহিনী প্রচলিত আছে, অনেক কাল আগে অত্র অঞ্চলে দুর্গম ঘন অরণ্যে একটি চোঙা আকৃতির পাহাড় ছিল। পাহাড়ের কোলে বাস করত ম্রো, বম, ত্রিপুরা প্রভৃতি আদিবাসীর দল। সেই পাহাড়ের চূড়ায় বাস করত এক ড্রাগন দেবতা। দেবতাকে তুষ্ট করতে প্রায়ই গবাদি পশুদের উৎসর্গ করতে হত। একসময় গ্রামের লোকজন অতিষ্ট হয়ে গুহায় থাকা ড্রাগনটিকে আক্রমণ করে হত্যা করে। সাথে সাথে ড্রাগনের গুহা থেকে ভয়ঙ্কর গর্জনের সঙ্গে আগুন বেরিয়ে আসে এবং পাহাড়ের চূড়ায় বিরাট গুহাটিতে পানি উঠে এক লেকের জন্ম দেয়। বম ভাষায় ড্রাগনকে বগা বলা হয়ে থাকে, তাই এই লেকের নামকরন করা হয় বগালেক। স্থানীয় আদিবাসীদের ধারণা, এই হ্রদের আশেপাশে দেবতারা বাস করে, এজন্য তারা এখনো লেকের পাশে পূজা দিয়ে থাকে।

ভূ-তত্ত্ববিদগণের মতে প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রাকৃতিক ভাবে পাহাড়ের চূড়ায় এই লেক তৈরি হয়। মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ কিংবা মহাশূন্য থেকে উল্কাপিণ্ডের পতনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে।

বগালেক বান্দরবন জেলা সদর হতে ৭০ কিলোমিটার দুরে রুমা উপজেলার পূর্ব দিকে নাইতং মৌজায় পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ৭০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই লেকের গভীরতা আনুমানিক ১৫০ - ২০০ ফুট, এর আয়তন ১৫ একর। এটি সম্পূর্ণ আবদ্ধ একটি লেক, এর আশেপাশে পানির কোন উৎসও নেই, সম্ভবত বৃষ্টির জল এর উৎস। এই লেকের পানি প্রতি বছর এপ্রিল থেকে মে মাসে ঘোলাটে হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এর তলদেশে উষ্ণ প্রস্রবণ রয়েছে, যে কারনে শীতকালেও লেকের পানি বেশ উষ্ণ থাকে। বিশালকায় মাছ আর প্রচুর জলজ লতাপাতায় ভরা এর তলদেশ।

যেভাবে যাবেন
বান্দরবান শহর থেকে চিম্বুক যাওয়ার পথে ওয়াই জংশন থেকে বাম দিকের রাস্তা ধরে পাহাড়ী রাস্তায় চান্দের গাড়ীতে করে যেতে হবে রুমা রুমা বাজার।

রুমা বাজার থেকে দুইভাবে বগা লেকে যাওয়া যায়। এক পাহাড়ী পথে হেঁটে, দুই চাঁন্দের গাড়ি করে। আপনি যে ভাবেই যান না কেন, রুমা বাজার থেকে গাইড সমিতির তালিকাবদ্ধ একজন গাইড নিতে হবে এবং বিজিবি ক্যাম্পে গাইডের নামসহ আপনাদের নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধ করতে হবে। গাইড-কে প্রতিদিনের জন্য দিতে হবে ৪০০-৫০০ টাকা।

পায়ে হেটে
আপনি যদি ত্র্যাডভেঞ্চার প্রেমী হোন তবে চাইলে পায়ে হেঁটেও রওনা দিতে পারেন। জেনে রাখা ভাল, বলা চলে এই পথটি অনেকটা ঝুকিমুক্ত কিন্তু পথ অনেক দীর্ঘ আর কষ্টের। ঝিরি পথ অনুসরণ করে হেঁটে চলতে থাকবেন, আর গাইডের কাছে বিভিন্ন গল্প শুনবেন। সময় লাগবে প্রায় ৫ থেকে ৭ ঘন্টা। যারা দৃঢ় মানসিক ও শারীরিক শক্তির অধিকারী এবং জীবনে রোমাঞ্চকর যাত্রার সম্মুখীন হতে চান কেবল তারাই এই পথে যাবার চিন্তা করবেন। এটি রীতিমত চ্যালেঞ্জ। এই পথে পাড়ি দিতে হবে কমপক্ষে ৫০টির মত ঝিরি, বহু উচুনিচু পাহার, পাথুরে পিচ্ছিল পথ, জঙ্গল আর ছোট বড় অনেক ঝর্না। পথটি কষ্টকর হলেও চারপাশের পরিবেশ বড়ই দৃষ্টি নন্দন এক কথায় অনিন্দ্য সুন্দর। প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী উপজাতীয় গ্রামের পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবেই।

চাঁন্দের গাড়ি
শুস্ক মৌসুমে যেতে পারেন চাঁন্দের গাড়ি করে, খুবই ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা, দূরত্ব ১৮ কিঃমিঃ, সময় লাগবে প্রায় ২ ঘন্টা ৩০ মিনিট। রুমা বাজারে অবশ্যই বিকাল ৪ টার আগে পৌছাতে হবে, কারন বিজিবি ক্যাম্প থেকে ৪ টার পরে বগালেক এর উদ্দেশে কোন গাড়ি ছাড়ার অনুমতি দেয় না। পথে পরবে অনেক ছোট বড় টিলা আর নাম না জানা অনেক ফলের বাগান, দেখবেন পাহাড়ি জীবনধারা, পার্বত্য বনাঞ্চল, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে দেখা মিলতে পারে বুনো হাতির পাল। পাহাড়ি উচু নিচু রাস্তায় গাড়ি চলতে গিয়ে প্রতিটা বাঁকেই আপনার মনে হবে এইবারই বুঝি গাড়িটা খাদে পড়ে গেল। জানা থাকা ভাল, এই গাড়ীগুলো পাহাড়ি রাস্তায় চড়ার জন্য বিশেষ উপযোগী এবং এর চালকগনও এসব পথে চলার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত, সুতরাং তেমন কোন সমস্যা হয়না।

বগালেকের নিচেই রয়েছে আরেকটি বিজিপি ক্যাম্প, এখানেও রিপোর্ট করতে হবে। বগা লেকের নিচ থেকে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে আপনার সময় লাগবে প্রায় ৪৫ মিনিট।

কোথায় থাকবেন
বগালেকের উপরেই উপজাতিয় বাড়িঘরে রাত্রি যাপনের সুবিধা পাবেন। খাবারের কাজটি সেরে নিতে পারেন সিয়াম দিদির হোটেলে। প্রতিদিন ২০০-৩০০ টাকার মধ্যে (২০১২) রাতে থাকার ও তিন বেলা খাবার ব্যাবস্থা হয়ে যাবে। খাবারের পাবেন মোটা লাল চালের ভাত, ডাল, ডিম ভাজা সাথে হয়তো পাহাড়ি কোন শাক। এরই সাথে পেয়ে যাবেন আদিবাসী বাড়িতে থাকা খাওয়ার অভিজ্ঞতা। বগা লেকে থাকার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন, লারাম - ০১৫ ৫২৩৭৬৫৫১, তবে মোবাইল নেটওয়ার্ক ভাল না থাকায় এই নম্বরটা সহজে পাওয়া যায় না। তবে ইতিমধ্যে এখানে পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের একটি অত্যাধুনিক রেস্ট হাউজ তৈরী হয়েছে।

হাতে সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন আদিবাসী বমদের গ্রাম। স্মৃতির ফ্রেমে বন্ধী করে রাখতে পারেন তাদের জীবন চিত্র। তবে পাহাড়িদের বিশেষ করে মেয়েদের বিনা অনুমতিতে ছবি নেবেন না। এই এলাকা আধুনিক সভ্যতা থেকে এতই বিচ্ছিন্ন যে, এখানে অনেকে বাংলায় কথা বলতে পারে না, এমনকি অনেক গোত্রের মেয়েরা সল্প বস্ত্র পরিধান করে।

ভ্রমনের উপযুক্ত সময়
অক্টোবর থেকে জানুয়ারী পর্যন্ত বগা লেক ভ্রমনের উপযুক্ত সময়। যত শেষের দিকে যাবেন বগালেক তত সুন্দর হবে এবং যত আগে যাবেন বগালেকে যাওয়ার রাস্তা তত কঠিন হবে।

খরচ
চান্দের গাড়ীঃ রুমা বাজার থেকে চাঁদের গাড়ীর ভাড়া সাধারনত ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকা, তবে পর্যটন মৌসুমে তা ৪০০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। লোকাল চাঁদের গাড়ীতেও বগালেক যাওয়া যায় ভাড়া জনপ্রতি ৭০ টাকা।

গাইডঃ গাইড-কে প্রতিদিনের জন্য দিতে হবে ৩০০-৫০০ টাকা।

থাকা খাওয়াঃ থাকা এবং খাবার জন্যে লারাম বম, সিয়াম বম সহ কয়েকটি দোকান রয়েছে, এগুলোই এখানকার রেস্ট হাউজ, এখানে প্রতিদিন ২০০-৩০০ টাকার মধ্যে রাতে থাকার ও তিন বেলা খাবার ব্যাবস্থা হয়ে যাবে। তবে বগালেকে একটি রেস্টহাউজ নির্মানাধীন আছে।

পাহাড়ি এলাকায় যাবার পূর্বে অবশ্য পালনীয় কিছু নিয়ম

  • ঝিরি পথ পাড়ি দিতে চাইলে প্লাষ্টিকের গ্রিপওয়ালা স্যান্ডেল পড়তে হবে।
  • পাহাড়ে সবসময় আইন মেনে চলবেন।  
  • কখনও পাহাড়ি কালচারের প্রতি অসম্মানজনক কোনো আচরণ বা মন্তব্য করবেন না।
  • বন্য জীবজন্তু বা পরিবেশের ক্ষতি করবেন না।
  • পাহাড়িদের বিশেষ করে মেয়েদের বিনা অনুমতিতে ছবি নেবেন না।
  • কোনো অবস্থাতেই গাইড ছাড়া একা কোথাও যাবে না।
  • ঝিরি পথে হেটে যাবার জন্য সঙ্গে উপযুক্ত পরিমান খাবার ও পানি সাথে নিবেন।

মন্তব্যসমূহ