প্রত্ন আর ঐতিহ্যের ভান্ডার কুমিল্লা

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, উপমহাদেশের বিশিষ্ট সুর স্রষ্টা শচীন দেব বর্মন, রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রস্তাবক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকার ডিজাইনার শিবনারায়ন দাশ সহ বহু জ্ঞানী গুণী মনিষীর স্মৃতিধন্য এই কুমিল্লা। প্রাচীন বঙ্গের বহু প্রত্ন নিদর্শনসহ বিভিন্ন কালের অনেক স্মৃতি চিহ্ন ছড়িয়ে আছে সমস্ত কুমিল্লা জুড়ে। শহরে কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রত্নস্থান - ময়নামতি কোটবাড়ির বৌদ্ধ বিহার, ময়নামতির পাহাড়, ওয়ার সিমেট্রি; লালমাই পাহাড়ে চন্ডীমুড়া মন্দির, জগন্নাথপুর সতের রত্ন মন্দির, ধর্মসাগর ইত্যাদি।

প্রত্ন নগরী ময়নামতি
উত্তরে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে দক্ষিনে লালমাই পাহাড় পর্যন্ত লম্বায় ১৭ কিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ময়নামতি পাহাড়ি অঞ্চল। প্রাচীন জনপদ সমতট রাজ্যের বিকাশমান এক নগর সভ্যতা ছিল এই ময়নামতি। কালের গ্রাসে যা ঢাকা পড়েছিল মাটির নিচে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে উন্মোচিত হয় হারিয়ে যাওয়া সেই নগরীর বেশকিছু স্থাপনা। গবেষকদের মতে ষষ্ঠ থেকে দশম শতাব্দির বৌদ্ধ শাসনামলে নির্মিত হয় এই সকল স্থাপনা, যা রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয়, শিক্ষা ও শিল্প চর্চায় ব্যবহৃত হত।
শালবন বিহার
প্রাচীন শিলালিপি, তাম্রলিপি, ধাতব মূদ্রা প্রভৃতি প্রত্ন তথ্য থেকে জানা যায়, ময়নামতি অঞ্চলটি প্রাচীনকালে দেবপর্বত, জয়কর্মান্তবসাক, পট্টিকেরা প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল।
খননে উন্মোচিত ময়নামতির গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ন স্থাপনাগুলো হচ্ছে শালবন বিহার বা ভবদেব বিহার, রূপবান মুড়া, ইটাখোলা মুড়া, আনন্দ বিহার, ভোজবিহার, কুটিলা মুড়া, চারপত্র মুড়া প্রভৃতি। নিদর্শন সমূহ ময়নামতির কোটবাড়িতে অবস্থিত। কোটবাড়ি পল্লী উন্নয়ন একাডেমির দক্ষিনে শালবন বিহার, পশ্চিমে ছোট পাহাড়ে ইটাখোলা ও রূপবান মুড়া, অন্যান্য স্থাপনা সমূহ পূর্ব ও উত্তর পাশে অবস্থিত।

ময়নামতি প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরঃ এ অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকালে যে সকল পুরাসামগ্রী খুঁজে পাওয়া যায় তা সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য ১৯৬৫ সালে কুমিল্লা কোটবাড়ির শালবন বিহারের দক্ষিণ পাশে এ জাদুঘর স্থাপন করা হয়। জাদুঘরে বিদ্যমান উল্লেখযোগ্য প্রত্ন মূর্তি হচ্ছে- বিভিন্ন ধরনের পাথরের দন্ডায়মান লোকোত্তর বুদ্ধ মূর্তি, বিষ্ণুমূর্তি, মঞ্জুরের মূর্তি, তারা মূর্তি, পার্বতী মূর্তি, মহিষমর্দিনী মূর্তি, হরগৌরীমূর্তি, নন্দী মূর্তি, গনেশ মূর্তি, মনসা মূর্তি, সূর্যমূর্তি এবং ব্রোঞ্জের বজ্রসত্ত্ব মূর্তি। অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ময়নামতিতে পাওয়া স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, পোড়ামাটির ফলক, ব্রোঞ্জ লোহা ও তামার তৈরী সামগ্রী, মাটির তৈরী বিভিন্ন প্রকারের খেলনা, কাঠের কাজের নিদর্শন, তুলট কাগজে লেখা প্রাচীন হস্তলিপির পান্ডুলিপি ইত্যাদি।

যেভাবে যাবেনঃ কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় অথবা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট বাস স্ট্যান্ড থেকে সিএনজি তে যেতে পারেন কোটবাড়ি। ঢাকা থেকে যেতে হলে কুমিল্লা বা লাকসামের যে কোনো বাসে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট পৌছে তারপর সিএনজি তে যেতে পারেন কোটবাড়ি।

কোথায় থাকবেনঃ কুমিল্লা শহরে অনেকগুলো ভাল মানের হোটেল আছে। কোটবাড়ির বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী -তে যোগাযোগ করে সেখানেও থাকতে পারেন।

লালমাই চন্ডীমুড়া মন্দির
ময়নামতি শৈল্য মালার সর্ব দক্ষিণে এবং কুমিল্লা শহর থেকে ১৩ কি মি দূরে লালমাই পাহাড়ের অবস্থান। লালমাই পাহাড়ের প্রধান বিশেষত এর লাল রঙের মাটি। 'কুমিল্লা জেলার ইতিহাস' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, লালমাই পাহাড় প্রায় সাড়ে তিন কোটি বছর পূর্বে সৃষ্টি হয়েছিল। পাহাড়ের নামকরন সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে - এক রাজার দুই মেয়ে ছিল, একজনের নাম লালমতি ও অন্যজন ময়নামতি। লালমতিকে বিয়ে দেয়া হয় দক্ষিন পাহাড়ি রাজ্যে, তার নাম অনুসারে এ একালাকার নাম হয় লালমাই। অপর মেয়ের নামানুসারে উত্তর অংশের নাম হয় ময়নামতি।
চন্ডীমুড়া মন্দির
লালমাই বাজার থেকে পশ্চিম দিকে বরুড়া যাওয়ার পথে সড়কের পাশে চন্ডীমুড়ার অবস্থান। পাহাড়ের প্রায় ৩০০ ফুট উপরে দেবী সর্বাণি সরস্বতী (কালী) ও একটি শিব মন্দির রয়েছে। খড়্গ রাজ বংশের শাসনামলে (৭ম শতকে) বৌদ্ধ রানী দেবী প্রভাবতী, মন্দির দুটি স্থাপন করেন।
প্রতি বছর তিনবার চণ্ডীমুড়ায় ভক্তবৃন্দের সমাবেশ ঘটে। কার্তিক মাসের কালীপূজার সময় দেওয়ানি উৎসব, পৌষ-মাঘ মাসে গীতা সম্মেলন এবং ফাল্গুন-চৈত্র মাসে বাসন্তী মহাঅষ্টমী। বর্তমানে সনাতন ধর্মালম্বী ছাড়াও নানা ধর্মের পর্যটক প্রতিদিনই এই মন্দির পরিদর্শনে আসেন।
কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা, কুমিল্লা বা ময়নামতি থেকে প্রথমে লাকসাম রোডে লালমাই নেমে তা্রপর রিক্সায় যেতে পারেন চন্ডীমুড়া।

ময়নামতি ওয়ার সেমেট্রি
এটি একটি কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত তৎকালীন ভারতীয় বৃটিশ সৈন্যদের কিছু সংখ্যক এখানে সমাহিত করা হয়। ১৯৪১-১৯৪৫ সালে বার্মায় সংঘটিত যুদ্ধে যে ৪৫০০০ কমনওয়েলথ সৈনিক নিহত হন, তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে মায়ানমার (তৎকালীন বার্মা), আসাম, এবং বাংলাদেশের ৯টি রণ সমাধিক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশে দুটি কমনওয়েলথ রণ সমাধিক্ষেত্র আছে, যার একটি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট অপরটি চট্টগ্রামে অবস্থিত।
রণ সমাধিক্ষেত্র
এখানে ৭৩৬টি কবর আছে। এটি Commonwealth War Graves Commission কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ও তারাই পরিচালনা করেন। নভেম্বর মাসে এখানে সকল ধর্মের ধর্মগুরুদের সমন্বয়ে একটি বার্ষিক প্রার্থণাসভার আয়োজন করা হয়ে থাকে। ওয়ার সিমেট্রি কুমিল্লার স্থানীয়দের নিকট ইংরেজ কবরস্থান নামে পরিচিত। সবুজে ঘেরা বিভিন্ন প্রজাতির ফুলগাছ বেষ্টিত এই জায়গায় গেলে আপনার মনে সিগ্ধতার পরশ ছুয়ে যাবে।
কুমিল্লা শহরের ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের সামান্য উত্তর পাশে কুমিল্লা-সিলেট রোডে ওয়ার সিমেট্রির অবস্থান। দেশের যেকোন স্থান থেকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বাস স্ট্যান্ড এসে তারপর পায়ে হেটে বা রিক্সায় যেতে পারেন এ রণ সমাধিক্ষেত্রে।

ময়নামতির পাহাড়
ইংরেজ কবরস্থান এর নিকটেই রয়েছে কিংবদন্তী রানী ময়নামতির পাহাড়। ওয়ার সিমেট্রি থেকে সামান্য উত্তর দিকে সাহেব বাজার, এবং এর পূর্ব দিকে এই ময়নামতি পাহাড়ের অবস্থান। মহারাজ মানিক চন্দ্র, রানী ময়নামতির অবকাশ যাপনের জন্য এই পাহাড়ে এক প্রাসাদ নির্মান করেছিলেন, অন্যান্য প্রত্ন স্থাপনার মত যা কালে ক্রমে ডিবিতে পরিনত হয়েছে। রাণীর কুটিরের পশ্চিম দিকে পাহাড়ের শেষাংশে নির্মাণ করা হয়েছিল রাজবাড়ির কালী মন্দির। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনী মন্দিরসহ রাণী কুটিরের বেশ ক্ষতি করলে বর্তমানে অবশিষ্টাংশ কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। প্রতি বছর এখানে বৈশাখী মেলা হয়ে থাকে।

ধর্মসাগর
কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বিশাল আকারের প্রাচীন দীঘিটিই হল ধর্মসাগর। বিকেল বেলাটা যারা শহরের আশে পাশে কাটাতে চান তাদের জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান। আপনি ইচ্ছে করলে নৌকা ভাড়া করে দিঘির ভেতরে ঘুরতে পারেন। ধর্মসাগরের উত্তর পাশে রয়েছে একটি শিশুপার্ক ও উদ্যান, তদসংলগ্ন রানী কুঠির যা ত্রিপুরা রাজা মানিক্য রায় বাহাদুরের রানীর অবকাশ ভবন।
১৪৫৮ সালে ত্রিপুরার অধিপতি মহারাজা প্রথম ধর্মমাণিক্য ধর্মসাগর খনন করেন। তৎকালীন সময়ে কুমিল্লা ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। এক সময় রাজ্যে দুর্ভিক্ষ-খরা দেখা দিলে প্রজাহিতৈষী রাজা এই অঞ্চলের দুঃখ-পীড়িত মানুষের জলের কষ্ট নিবারণ করার লক্ষ্যে এই দীঘিটি খনন করেন। মহারাজা ধর্মমাণিক্যের নামানুসারে এর নাম রাখা হয় ধর্মসাগর।

জগন্নাথপুর সতের রত্ন মন্দির
জগন্নাথপুর সতের রত্ন মন্দির
কুমিল্লা শহরে হতে ৫ কিলোমিটার পূর্ব দিকে, বিবির বাজার রোডে জগন্নাথপুর গ্রামে সতের রত্ন নামক জগন্নাথ মন্দিরটি ত্রিপুরার মহারাজা কৃষ্ণ মাণিক্য প্রতিষ্ঠা করেন।
ত্রিপুরার অধিপতি দ্বিতীয় রত্ন মানিক্য (১৬৮৬-১৭১২) এই মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করেন কিন্তু এ কাজ শেষ হওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রায় চল্লিশ বছর পরে মহারাজা কৃষ্ণ মানিক্য ১৭৬১ সালে এই মন্দির নির্মানের কাজ সমাপ্ত করেন।
অষ্টভুজাকৃতি মন্দিরটি চারতলার বিশিষ্ট এবং সর্বোচ্চে ত্রিকোনাকার চূঁড়া রয়েছে। এই মন্দিরে মোট সতেরটি চূড়া থাকায় এটির নাম সতের রত্ন মন্দির। এটি বাংলাদেশের অষ্টভুজ কাঠামোর একমাত্র মন্দির। বর্তমানে মন্দিরের বেশীরভাগ চূড়া নষ্ট হয়ে গেছে। এই পাথুরে স্থাপনাটি বাংলাদেশ প্রত্নত্বত্ত অধিদপ্তরের স্বীকৃত পুরাকীর্তি। এ মন্দিরে রথ যাত্রা হয়ে থাকে। বর্তমানে এ মন্দিরের পাশে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘের (ISKCON) তত্ত্বাবধায়নে আরো একটি মন্দির ও আশ্রম পরিচালিত হচ্ছে।


উল্লেখযোগ্য পণ্য
কুমিল্লা বেড়াতে গেলে এখানকার বিখ্যাত মিষ্টি রসমালাই খেয়ে আসতে ভুল করবেন না। সবচেয়ে ভাল মানের রসমলাই পাবেন এর প্রস্তুতকারক মাতৃভান্ডার মিষ্টির দোকানে যা কুমিল্লার কান্দিরপাড় মনোহরপুর কালিবাড়ীর ঠিক বিপরীতে অবস্থিত। এছাড়াও এখানকার খদ্দর বা খাদি (সনাতন পদ্ধতিতে হাতে বুনা কাপড়) বেশ প্রসিদ্ধ। ভাল খাদি পাবেন মনোহরপুর সহ লাকসাম রোডের দোকানসমূহে।

কিভাবে যাবেন কুমিল্লা
ঢাকা থেকে সড়ক পথে কুমিল্লার দূরত্ব ৯৬ কিলোমিটার। যেতে সময় লাগে ২.৩০ ঘন্টা। ভাড়া ১৮০-২৫০ টাকা (২০১৭)। ঢাকার কমলাপুর ও সায়দাবাদ থেকে বি আর টি সি, তিশা, এশিয়া লাইন, কর্ডোবা ইত্যাদি এসি বা নন এসি বাসে সরাসরি ময়নামতি বা কুমিল্লা শহরে যেতে পারেন।

কোথায় থাকবেন
থাকার জন্য কুমিল্লায় বিভিন্ন মানের হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে হোটেল চন্দ্রিমা, হোটেল সোনালী, হোটেল, শালবন, হোটেল, নিদ্রাবাগ, আশীক রেস্ট হাউস ইত্যাদি অন্যতম। 

মন্তব্যসমূহ