শ্যামল স্নিগ্ধ শহর শ্রীমঙ্গল

দেশের চা শিল্প ও বৃষ্টিপ্রধান অঞ্চল হিসেবে শ্রীমঙ্গল সুপরিচিত। এখানকার মৃদুমন্দ ঢালু পাহাড় ও প্রাকৃতিক পরিবেশ চা উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। মণিপুরি আর খাসিয়া আদিবাসীরা এই পাহাড়ি এলাকার প্রধান বাসিন্দা। তাদের ঐতিহ্যে ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে এই উপজাতি পল্লী থেকে ঘুরে আসতে পারেন।

যেভাবে যেতে হবে
ট্রেনঃ ঢাকা থেকে প্রতিদিন তিনটি আন্তঃনগর ট্রেন সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। পারাবত এক্সপ্রেস সকাল সাড়ে ৬টায়, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস দুপুর ২টায় এবং উপবন রাত সাড়ে ১০টায়। এ সকল ট্রেনে আপনি শ্রীমঙ্গল যেতে পারেন। ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গলে ট্রেন চেয়ার কোচের ভাড়া ১৩৫ টাকা, ১ম শ্রেণীর চেয়ার ২০০ টাকা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচে ৩০০ টাকা এবং স্লিপিং কোচে ৩৬০ টাকা।

বাস সার্ভিসঃ ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে শ্যামলী পরিবহন, হানিফ, মৌলভীবাজার সিটি, সিটিলিংক, মিতালী প্রভৃতি বাসে আপনি যেতে পারেন শ্রীমঙ্গল। নন এসি বাসে ভাড়া ২৫০ টাকা, এসি বাসে ভাড়া পড়বে ৪০০ টাকা।

কোথায় থাকবেন
শ্রীমঙ্গল শহরে ২০টিরও বেশি আবাসিক হোটেল রয়েছে, এর মধ্যে - টি টাউন রেস্ট হাউজ, নিরালা রেস্ট হাউজ, হোটেল বিরতি, এলাহী প্লাজা, আল-রহমান, হোটেল মুক্তা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও সরকারি ও আধা সরকারী সংস্থাসমূহের বেশ কিছু বাংলো রয়েছে। কর্তৃপক্ষের পূর্ব অনুমতি সাপেক্ষে এখানেও থাকতে পারেন। কয়েকটি হোটেলের ফোন নম্বর - টি টাউন গেষ্ট হাউজ ০৮৬২৬৩৭০, টি রিসোর্ট ০৮৬২৬২০৭, মিড লেভেল সেন্ডি হোটেল ০৮৬২২৪৩।

শ্রীমঙ্গলে থাকার সবচেয়ে রোমান্টিক স্থান হল রাধানগর ইকোকটেজ। একটি ছোট ঝর্নার পাশে দেশীয় আমেজে তৈরী এ কটেজ। ভাড়া ১৫০০ টাকা, থাকতে পারবেন ২-৩ জন, ফোন ০১৭১৫০৪১২০৭ ।

খাওয়া দাওয়া
শহরে প্রচুর খাওয়ার হোটেল রয়েছে। মাছ, মাংস, সব্জি সবরকম বাঙালী খাবারই এখানে পাওয়া যায়। তবে হিন্দু অধ্যুশিত এলাকা বলে শ্রীমঙ্গলের কোন হোটেলে গরুর মাংস রান্না হয়না।

ব্যাতিক্রমী যা খাবেন - সাত স্তরের চা
শ্রীমঙ্গলে রমেশ গৌড় ২০০০ সালে এক গ্লাসে দু’স্তরের চা তৈরি করে সাড়া দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পরবর্তিতে মেধা শ্রমকে কাজে লাগিয়ে নিজ চেষ্টায় এক গ্লাসে ৭ স্তরের চা তৈরী করতে সক্ষম হন। বর্তমানে রামনগর মনিপুরী পাড়া নীলকন্ঠ চা কেবিনে তিনি বিক্রি করেন ব্যতিক্রমী এই চা। শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে আসলে অন্তত একবার চলে আসুন রমেশের নীলকন্ঠ চা কেবিনে।

শ্রীমঙ্গলে দর্শনীয় স্থান সমূহ

চা বাগান

শ্রীমঙ্গল উপজেলায় জেমস, ফিনলে, ইস্পাহানী প্রভৃতি চা কোম্পানী ও ব্যক্তি মালিকানাধীন মিলিয়ে ছোট-বড় ৩৮টি চা বাগান রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চা বাগানের সবুজ বেস্টনির মাঝে অবস্থিত সিগ্ধ শহর শ্রীমঙ্গল। চা বাগানে প্রবেশ করার পর মনে হবে কোন চিত্রশিল্পী মনের মাধুরী মিশিয়ে সবুজ-শ্যামল চিত্র কর্ম তৈরী করে রেখেছে। মহিলা চা শ্রমিকদের চা পাতা উত্তোলনের মনোরম দৃশ্যও চোখে পড়বে। শহরের আশে পাশেই ভাড়াউড়া, বুড়বুড়িয়া, ফুলছড়া, কালীঘাট, সিন্দুরখান, কাকিয়াছড়া, রাজঘাট ইত্যাদি চা বাগান অবস্থিত। বাগানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে হলে অবশ্যই বাগান কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে, এসব বাগানের কারখানায় প্রবেশ করে কাচাঁ পাতা থেকে চা তৈরীর প্রক্রিয়াও দেখা আসতে পারেন।

শ্রীমঙ্গল ওয়্যার সিমেট্রি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী সময়ে যে সব ব্রিটিশ নাগরিক তথা চা বাগান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের কবর। ছোট অথচ অত্যন্ত আকর্ষনীয় এক স্থানটি দেখতে চাইলে শ্রীমঙ্গল শহর থেকে গাড়িযোগে চলে যান খেজুরীছড়া চা বাগানের ফ্যাক্টরির সামনে। সেখান থেকে ডানদিকে রাজঘাট চা বাগানের রাস্তায় সামান্য এগুলেই ডান পাশে চোখে পড়বে ওয়্যার সিমেট্রিটি। প্রতিদিন অসংখ্য বিদেশী পর্যটক এখানে এসে প্রার্থনা করে যান।


শ্রীমঙ্গল খাসিয়া পান পুঞ্জি

সিলেট বিভাগে ৭৫টি খাসিয়া পান পুঞ্জি এর মধ্যে শ্রীমঙ্গলে পান পুঞ্জির সংখ্যা দশ। উপজাতি খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন বিভিন্ন দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় সুউচ্চ পাহাড়ি টিলা পরিস্কার করে বসবাসের উপযোগি ঘর তৈরী ও পান চাষে আত্মনিয়োগ করে। এসব পান চাষের এলাকাকে পুঞ্জি বলে। প্রতিটি পান পুঞ্জিতে ২৫/৩০টি পরিবার গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বসবাস করে। খাসিয়া সম্প্রদায়ের জীবন জীবিকা সম্পর্কে ধারনা পেতে চলে আসুন নাহার, নিরালা, চলিতাছড়া, লাউয়াছড়া প্রভৃতি পান পুঞ্জিতে।

শ্রীমঙ্গল মনিপুরী পাড়া

মনিপুরী তাত বস্ত্র ও হস্ত শিল্প বেশ প্রসিদ্ধ। মণিপুরী নৃত্য তাদের সংকৃতির অন্যতম অনুষ্ঠান। বাংলা সনের কার্তিক মাসের শেষ পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় মনিপুরীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব "রাসোৎসব"। এ সময় কমলগঞ্জের মাধবপুরস্থ জোড়ামন্ডপ এবং আদমপুরস্থ মনিপুরী শিক্ষা-সংস্কৃতি কেন্দ্রে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনের জন্য।

লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক

শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ১০ কিমি দূরে ভানুগাছ-কমলগঞ্জের রাস্তার পাশে অবস্থিত লাউয়াছড়া বনাঞ্চল। এখানে প্রায় ২৫০ প্রজাতির পাখি, ১০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫০ প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে। এখানকার বন্যপ্রাণীর মধ্যে মায়া হরিণ, লজ্জাবতী বানর, গন্ধগোকুল, উল্লুক, বন মোরগ, সজারু, অজগর সাপ, গুই সাপ, হনুমান, মেছোবাঘ, চিতা বিড়াল, বন্য শূকর, শেয়াল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। লাউয়াছড়ার অন্যতম প্রধান প্রাণীটি হলো উল্লুক। জীববৈচিত্র গবেষণা পত্রাদি থেকে জানা যায়, উল্লুক দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র বন মানুষ। তাছাড়া এখানে রয়েছে টিকওক ট্রি, যা ক্লোরোফিল ট্রি নামেও পরিচিতি। শ্রীমঙ্গল থেকে অটোরিক্সা ভাড়া করে ঘুরে আসতে পারেন লাউয়াছড়া।


সীতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা

সীতেশ রঞ্জন দেব, শিকারি সীতেশ বাবু নামে অধিক পরিচিত। নিজ উদ্দ্যোগে তৈরী এই মিনি চিড়িয়াখানাকে বন্য পশুপাখির সেবাশ্রম বলা যেতে পারে। এখানে বিভিন্ন জাতের দেশি-বিদেশি পাখিসহ বিলুপ্তপ্রায় অনেক পশু দেখে অবিভূত হবেন আপনারা। একমাত্র এখানেই দেখতে পাবেন বিরল প্রজাতির সাদা বাঘ, এটি ক্রোধান্বিত হলে চোখের রং পরিবর্তন হয়। তার দুর্লভ সংগ্রহ দেখতে দেশ বিদেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক এসে থাকে। বর্তমানে হাইল হাওরঘেঁষা নিজের জমিতে স্থানান্তর করেছেন এটি।

যেভাবে যেতে হবেঃ শ্রীমঙ্গল থেকে মৌলভীবাজার রোডে কালাপুর বাজার, তারপর টার্ন নিয়ে চলে যাবেন হাজীপুর এর ঘাটেরবাজার। সেখান থেকে মোটর সাইকেলে বা পায়ে হেটে প্রায় ৩/৪ কিমি দুরে হাইল হাওর। আপনি চাইলে হাজীপুর বাজার থেকে গাইড নিয়ে যেতে পারেন সীতেশ বাবুর মিনি চিড়িয়াখানায়।

মাধবপুর লেক

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় মাধবপুর ইউনিয়নের পাত্রখলা চা বাগানে অবস্থিত মনোরম এই লেক। শ্রীমঙ্গল থেকে এর দুরত্ব প্রায় ১৫ কিমি। সিএনজিতে শ্রীমঙ্গল থেকে যাবেন ভানুগাছ, সেখান থেকে আবার সিএনজিতে মাধবপুর বাজার, তারপর রিক্সায় পৌঁছবেন মাধপুর লেক। ভাড়া প্রতি ক্ষেত্রে ২০-২৫ টাকা। চারিদিকে সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝখানে ছায়া সুনিবিড় পরিবেশে আর শাপলা শালুকের উপস্থিতি লেকটিকে করেছে আরও শৈল্পিক।

রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য

এই বনের অবস্থান হবিগঞ্জ জেলায়। শ্রীমঙ্গল থেকে চুনারুঘাট, তারপর জীপে অথবা অটোরিকশায় যেতে পারেন রেমা কেলেঙ্গা অভয়ারণ্য। বন মধ্যে প্রবেশের পর চোখে পড়বে অসম্ভব সুন্দর একটি লেক। বন্য প্রাণীদের খাবার পানির চাহিদা মেটাতেই এটি তৈরি করা হয়েছে। এই অভয়ারণ্যে ৬৩৮ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৭ প্রজাতির উভয়চর প্রাণী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য বন্য প্রানী - হনুমান, বানর, কালো ও সাদা বন্যশুকর,  ছোট হরিন, মেছোবাঘ, মেছোবিড়াল, রামকুত্তা, বনকুকুর, খরগোশ, প্রভৃতি। ত্রিপুরা, সাওতাল, উড়ং এই তিন আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন যুগ যুগ ধরে এখানে সম্মিলিত বসবাস করছে। এখানে বেড়াতে গেলে বৈচিত্র্যে ভরা আমাদের দেশের অন্য এক রূপ দেখতে পাবেন।

শ্রীমঙ্গলের আশে পাশে আরও যা যা দেখবেন - লাল মাটির পাহাড়, রাবার বাগান, ভাড়াউড়া লেক, রাজঘাট লেক, সাতগাঁও লেক, হরিণছড়া লেক, শ্যামলী পর্যটন কেন্দ্র ইত্যাদি।

মন্তব্যসমূহ