টেকনাফ - বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের ভূমি

পাহাড়, নদী আর সমুদ্রের অনন্য এক মিলনস্থল বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের ভূমি টেকনাফ। কক্সবাজার থেকে এর দূরত্ব ৮৫ কিলোমিটার। টেকনাফের পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নাফ নদী যা বাংলাদেশ ও মায়ানমারের ভূখন্ডকে পৃথক করেছে। টেকনাফের সমুদ্র সৈকতটিও চমৎকার। বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন সৈকত বলা যায় এটিকে।

যাওয়া থাকা
কক্সবাজার থেকে বাস ও মাইক্রোবাসে টেকনাফ যেতে পারেন, বাস ভাড়া ৮০-১২০ টাকা আর মাইক্রোবাসে ১০০-১৫০ টাকা (২০১২)। কক্সবাজার থেকে টেকনাফের বাস ছাড়ে আন্তজিলা বাস টার্মিনাল থেকে, আর মাইক্রোবাসগুলো শহরের কলাতলী এবং টেকনাফ বাইপাস মোড় থেকে ছাড়ে। থাকার জন্য এখানে আছে ৩০০-১৫০০ টাকার মধ্যে বিভিন্ন মানের বেশ কয়েকটি হোটেল।

যা যা দেখবেন
সমূদ্র সৈকত ছাড়াও এখানে আছে বিস্তীর্ণ গেম রিজার্ভ ফরেষ্ট, নাইটং বা দেবতার পাহাড়, শাহ পরীর দ্বীপ, টেকনাফ নেচার পার্ক, বার্মিজ মার্কেট, দেবতার পাহাড়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ সৈন্যদের তৈরী করা বাংকার, কুঠি পাহাড়, মাথিনের কূপ, কুদুম গুহা প্রভৃতি রোমাঞ্চকর স্পট।

টেকনাফ গেম রিজার্ভ ফরেষ্ট
কক্সবাজার থেকে ৪৮ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং টেকনাফ থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তরে এই সংরক্ষিত বনের অবস্থান। আয়তন ১১ হাজার ৬১৫ হেক্টর। লম্বা ও সরু পাহাড়ের শ্রেণী দক্ষিণ থেকে উত্তরে বিস্তৃত। টেকনাফ গেম রিজার্ভ ফরেষ্টে ভ্রমণের সময় প্রশিক্ষিত গাইড সঙ্গে নেওয়া জরুরি। বাজারের কাছে কক্সবাজার-টেকনাফ রোডের পাশে নিসর্গ অফিসে গাইডের খোঁজ করতে পারেন। বাংলাদেশের বুনো হাতির সবচেয়ে বড় দলটি থাকে এই গেম রিজার্ভে, যা দেশের মোট হাতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এছাড়া এই বনে বিলুপ্তপ্রায় বুনোকুকুর, উল্লুক, সম্বর হরিণ, উড়ক্কু কাঠবিড়ালী, শজারু প্রভৃতি প্রাণী রয়েছে। গেম রিজার্ভের অন্যতম আকর্ষণ এক হাজার ফুট উঁচু তৈঙ্গা চূড়া। এখান থেকে বঙ্গোপসাগর, শীলখালী গর্জন বন, নাফ চ্যানেল ও মিয়ানমার পাহাড়শ্রেণী দেখা যায়। প্রায় ৭০০ ফুট উঁচু শিলাময় তৈঙ্গা পাহাড় থেকে নেমে আসা স্ফটিক স্বচ্ছ জলের ঝর্না দেখে আসতে ভুল করবেন না। এই ঝিরির ধারা বন্য প্রাণীদের জলের প্রয়োজন মেটায়।

নাইটং পাহাড়
টেকনাফ শহরের কাছেই নাইটং পাহাড়। প্রায় ৭০০ ফুট উঁচু এই পাহাড়ে উঠতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে বুনো হাতির দলের সাক্ষাৎ পেতেও পারেন। হাতি দেখার সময় সতর্ক থাকুন; এরা বিরক্ত হলে মানুষ মারতে দ্বিধাবোধ করে না।

ভঙ্গিল পাহাড়
বিশেষজ্ঞদের মতে সুদুর অতীতে এই পাহাড় শ্রেণী সমূদ্রে নিমজ্জিত ছিল। ভালোভাবে দেখলে এর শিলাস্তরে শামুক-ঝিনুকের জীবাশ্ম বা ফসিল এবং সল্টক্রিক বা লবণাধার দেখা যায়। বুনো প্রাণীর লবণের চাহিদা মেটায় এই সল্টক্রিক।

কুদুম গুহা
হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বাজার থেকে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এই প্রাকৃতিক গুহার অবস্থিত। গুহার প্রবেশমুখ প্রায় ১২ ফুট উঁচু। গুহার দেয়ালের গা বেয়ে অনবরত পানি ঝরে। প্রবেশ পথে প্রায় হাঁটু পানি এবং ভেতরে প্রবেশ করলে পানির গভীরতা বাড়তে থাকে। গুহার ভেতর ভাগ অন্ধকারাচ্ছন্ন আর রয়েছে প্রচুর নানা প্রজাতির বাদুর। গুহার স্বচ্ছ মিষ্টি পানিতে রয়েছে নানা ধরনের ছোট বড় মাছ। স্থানীয় লোকদের মতে চামচিকা শিকারের জন্য এই গুহায় পাহাড়ি অজগর আসে। গুহায় প্রবেশ করতে চাইলে সঙ্গে হেডলাইট ও আত্মরক্ষামূলক লাঠি নিতে ভুলবেন না।
জনশ্রুতি আছে, গভীর বনে তৈংগ্যা পাহাড়ে এই গুহা তৈরি হয় হাজার বছর আগে। এক রাজা পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গটি তৈরি করেছিলেন। যুদ্ধের সময় এই সুড়ঙ্গকে গোপন পথ হিসেবে ব্যবহার করতেন। কিন্তু আরাকান মগ দস্যুর হাতে ওই রাজার মৃত্যু হলে সুড়ঙ্গটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর গাছপালা আর আগাছা জন্মে সুড়ঙ্গটি ভয়ংকর রূপ নেয়।
এই গুহার আরেক মুখ রয়েছে তৈংগ্যা পাহাড়ের পশ্চিম পাশে বঙ্গোপসাগরের তীরে, বাহারছড়া গ্রামে। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। স্থানীয়দের মতে কেউ এই গুহার এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে অন্য প্রান্ত দিয়ে বেরিয়েছে, এমনটা কখনো শুনেনি। তবে অনেকে চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সর্বোচ্চ এক মাইল পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসেছেন।

মাথিনের কূপ
বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে কলকাতার ধীরাজ ভট্টাচার্য নামে এক পুলিশ কর্মকর্তা টেকনাফ থানায় বদলী হয়ে আসেন। এ সময় সেকানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের এক রাজার কন্যা থানায় অবস্থিত পাত কুয়া থেকে পানি আনতে যেত। থানার নবাগত সুদর্শন তরুণ কর্মকর্তা ধীরাজ থানায় বসে বসে মাথিনের পানি আনা-নেয়া দেখতেন। এভাবে ধীরাজের সঙ্গে মাথিনের দৃষ্টি বিনিময় প্রেমে পরিণত হয়। গোত্র আভিজাত্যের প্রতিবন্ধকতায় ধীরাজ-মাথিনের বিয়ে হয়নি। সমধুর প্রেমের করুণ বিচ্ছেদে মাথিন তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করেন। চৌদ্দ বছর বয়সী মাথিন ও ধীরাজের নিখাদ প্রেমের ঐতিহাসিক নিদর্শন এ মাথিনের কূপ। কূপটি টেকনাফ থানার সম্মুখে অবস্থিত।

মন্তব্যসমূহ