কক্সবাজারের মহেশখালী - বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরা এ জায়গাটিতে রয়েছে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের চমৎকার বেশ কয়েকটি মন্দির। মহেশখালীতে বহু দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আদিনাথ মন্দির প্রধান দর্শনীয় স্থান। বঙ্গোপসাগর ঘেরা মৈনাক পর্বতের চুড়ায় মনোরম পরিবেশে এই শিব মন্দিরটির অবস্থান। আদিনাথের অপর নাম মহেশ। এই মহেশের নাম অনুসারে দ্বীপটির নাম মহেশখালী।

যেভাবে যেতে হবে 
কক্সবাজার থেকে কস্তরী ঘাট বা মহেশখালী ঘাট যেতে হবে রিকশায়। তারপর স্পীড বোট কিংবা লঞ্চে মহেশখালীর গোরকঘাটা ঘাট । স্পীড বোটে মহেশখালীর ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা (২০১২) আর সময় লাগে মাত্র ১৫ মিনিট; লঞ্চে ভাড়া ৩০ টাকা, সময় লাগে ১ ঘন্টার মতো। স্টেশনে নেমে একটি রিকশা ঠিক করতে পারেন সারা দিনের জন্য। রিকশাওয়ালাই গাইড করবে আপনাকে।

যা যা দেখবেন
স্টেশন থেকে প্রথমেই চলে যান বৌদ্ধ মন্দিরে। এখানে সোনালী রঙের দু’টি বৌদ্ধ মন্দির দেখতে খুবই সুন্দর। এখান থেকে বেরিয়ে সামনেই পড়বে উপজাতীয়দের তৈরি তাঁতবস্ত্রের দোকান।
বৌদ্ধ মন্দির থেকে বেরিয়ে চলুন মহেশখালীর আকর্ষণ-আদিনাথ মন্দিরের উদ্দেশ্যে। রিক্সায় ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই পৌছে যাবেন আধিনাথ। সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়ুন মন্দিরে। মূল মন্দির প্রায় ৫০০ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মন্দিরের ভেতরেই রয়েছে শ্বেত পাথরে অষ্টভুজা দুর্গা মন্দির। পূর্বে যা নেপাল রাজদরবারে ছিল। বর্তমান ভবন ও অষ্টভুজার মন্দির স্থাপিত হয় প্রায় তিনশত বৎসর পূর্বে নেপাল রাজ্যের সহয়তায়।
আদিনাথ মন্দির থেকে আরেকটু সামনেই পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে আরেকটি বৌদ্ধ মন্দির। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মন ভরে দেখে নিন চারপাশের সমুদ্রকে। আদিনাথ মন্দির থেকে নেমে চলে আসুন জেলে পাড়ায়। এখানকার জেলেদের জীবনযাপনের সাথে পরিচিত হতে পারেন। এছাড়া সমুদ্রের পাড়ে দেখতে পারবেন বিচিত্র শামুক আর ঝিনুক। মহেশখালীর যে-কোনো রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিতে পারেন মজার মজার সামুদ্রিক মাছ। কম দামে এখানে খেতে পারেন মজাদার রূপচাঁদা বা কোরাল। যারা শুঁটকি পছন্দ করেন তারা এখান থেকে কিনতে পারেন নানান ধরনের শুঁটকি।
মহেশখালীর আদিনাথ বাজার, জয়ের খাতা, হরিয়ার চরা, জেমঘাট, পাকুয়া, মাতার বাড়ি, পশ্চিমপাড়া প্রভৃতি জায়গাগুলোও চমৎকার। এসব জায়গায়গুলোতে ঘুরেও পেতে পারেন ভিন্ন স্বাদ ও অভিজ্ঞতা।

কোথায় থাকবেন 
মহেশখালীতে থাকার তেমন ভালো কোন ব্যবস্থা নেই। তবে সেটা কোন সমস্যাই না। কেননা কক্সবাজার থেকে সকালে গিয়ে এ দ্বীপটি ভালো করে দেখে আবার বিকেলের মধ্যেই ফেরা সম্ভব। মহেশখালীতে মোটামুটি ভালো থাকার হোটেল হলো ‘হোটেল সি গার্ডেন’।

কিংবদন্তী
শ্রী শ্রী আদিনাথের মৈনাক পাহাড়ে অবস্থান নেওয়া এবং আবিষ্কার সম্পর্কে একটি সুন্দর জনশ্রুতি আছে। এলাকাবাসীদের মতে ঘটনাটি সত্য।
কিংবদন্তী অনুসারে, ছোট মহেশখালীর তৎকালীন এক প্রভাবশালী বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ সিকদার, মাঝে মাঝেই পাহাড়ে হরিণ শিকার করতে যেতেন। একদিন হরিণ শিকার করতে গিয়ে সারা দিন এদিক-ওদিক ঘুরেও শিকারের সন্ধান না পেয়ে একটি গাছের নিচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হঠাৎ কিছু একটা শব্দে তার তন্দ্রা ভাঙ্গে। শব্দ অনুসরণ করে তিনি দেখতে পান যে, একটি গাভী একটি মসৃণ শিলাখন্ডের উপর বাট থেকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে দুধ ঢালছে; এই গাভীটি তারই গোয়ালঘর থেকে কিছুদিন আগে হারিয়ে যায়। গাভী আর সেই সুন্দর শিলাখন্ডটি নিয়ে তিনি বাড়ি ফেরেন। সেদিন রাতেই তিনি স্বপ্নে দেখতে পান: এক মহাপুরুষ তাঁকে বলছেন যে, শিলাখন্ডটি একটি দেব বিগ্রহ। এ বিগ্রহ যেখান থেকে নিয়ে এসেছেন সেখানে রেখে তার উপর একটি মন্দির নির্মাণ করতে হবে। মন্দিরের নাম হবে আদিনাথ মন্দির। এ আদিনাথের (শিবের) ১০৮ নামের মধ্যে "মহেশ" অন্যতম। আর এই মহেশ নাম হতেই পরবর্তীতে এই স্থান নাম হয় মহেশখালী ।
স্বপ্নাদেশ পেয়ে হাজী সাহেব একটি কাঁচা ঘরের মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেন। সেই মন্দিরটি এখন নেই, তার স্থান বর্তমান মন্দির থেকে কিছু দুরে ছিল বলে জানা যায়। হাজী নুর মোহাম্মদ সিকদারের সেই গাভীর দুধ দ্বারা শিলারূপী শিবের স্নান ও পূজা চলতে থাকে। আবার নুর মোহাম্মদ সিকাদার স্বপ্নে দেখেন শিবের শক্তি অষ্টভূজাকে এই মৈনাক শিখরে আদিনাথের পাশে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বপ্নে তিনি আরও দেখেন একজন সন্ন্যাসী, একজন মহিলা ও একজন কিশোরকে সমুদ্র তীরে পাওয়া যাবে। আর ঐ নাগা সন্ন্যাসীর মাধ্যমে অষ্টভূজা আনতে হবে নেপাল রাজদরবার থেকে।

সিকদার সাহেব সত্যি সত্যিই নির্দেশিত ব্যক্তিদের সমুদ্র চরে দেখতে পান। নাগা সন্ন্যাসী সিকদার সাহেবের স্বপ্নের কথা অবহিত হয়ে অষ্টভূজার জন্য নেপাল গমন করেন এবং ১৬১২ সালে নেপাল ষ্টেইটের মন্দির থেকে চুরি করে নিয়ে আসার সময় ধরা পড়ে জেল বন্ধি হয়ে পড়েন। কলকাতা এক আদালতে মামলা উঠে। তিনি জেলে বসে ভাবতে থাকেন, কিভাবে অষ্টভূজা ফিরে পাওয়া যায়। রায় ঘোষনা হবার পূর্ব রাত্রিতে এই নাগা সন্ন্যাসী যোগমায়া বলে মহাদেবের কৃপা লাভ করেন এবং মহাদেব অভয় বাণী দেন - বিচারক তোমাকে যে প্রশ্নই করুক না কেন তুমি নির্ভয়ে তোমার মুখ দিয়ে যাহা বের হবে তাহাই বলিবে। পরের দিন মহামান্য বিচারক নেপাল রাজাকে প্রশ্ন করে মুর্তিটির রং জানতে চান। রাজা উত্তরে মুর্তির রং কালো কষ্টি পাথরের বর্ণনা দেন, এবং নাগাসন্ন্যাসী তার কাছে থাকা মুর্তিটির রং সাদা বলে জানান। মহামান্য বিচারক সকলের সম্মুখে মুর্তি উন্মোচন করে দেখেন মুর্তিটির রং সাদা। ফলে নাগাসন্ন্যাসীর পক্ষে রায় ঘোষনা হয়। নেপালের রাজা ক্ষমা প্রার্থনা করে সন্ন্যাসীর নিকট প্রকৃত ঘটনা জানতে চায়। তখন নাগাসন্ন্যাসী বিস্তারিত খুলে বলেন। এতে ঐ রাজাই এই মুর্তিটিকে যথাযথ মর্যদার সহিত এই মৈনাক পর্বতে শ্রী শ্রী আদিনাথের পার্শ্বেই স্থাপিত করে এবং মূল মন্দির নির্মাণ করে যান। এখনো প্রায় সময় নেপাল সরকার আদিনাথ মন্দিরে অনুদান দিয়ে থাকেন।

মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির বিশ্বের হিন্দু সম্প্রদায়ের নিকট অন্যতম তীর্থস্থান। বর্তমানে সীতাকুন্ড স্রাইন কমিটি আদিনাথ মন্দিরের সার্বিক দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আদিনাথ মন্দিরে প্রতিদিন প্রধান পুরোহিত দৈনন্দিন পূজা অর্চ্চণা করেন এছাড়াও শিবচতুর্দশীতে বিশেষ পুজা ও উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলা ৭ থেকে ৮ দিন ধরে চলে। মহেশখালীতে কোন দূর্গা বানানো হয় না কারণ স্বয়ং অষ্টভূজা দূর্গা এখানে জাগ্রত আছেন।

পৌরাণিক ইতিহাস
আদিনাথের গোড়াপত্তন কয়েক হাজার বৎসর পূর্বে ত্রেতাযুগে, এর একটি ঐতিহাসিক সত্যতা রয়েছে এবং তাহা পাওয়া যায় হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ, রামায়ণ, পুরাণ ও ঐতিহাসিকদের বর্ণনায়। ত্রেতা যুগে রাবণ যুদ্ধে রামের সঙ্গে জয় লাভের জন্য দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে বর প্রার্থনা করেনে। এই সময়ে মহাদেব কৈলাসে ধ্যান মগ্ন রাবণের আরাধনার দেবাদিদেব সন্তুষ্টি হয়ে রাবণকে বর দিলেন। তবে সঙ্গে শর্ত জুড়ে দিলেন। শর্ত হল শিবরূপী উর্ধমুখী শিবলিঙ্গকে কৈলাস থেকে বহন করে লংকায় নিয়ে যেতে হবে, পথমধ্যে কোথাও রাখা চলবে না। যদি পথমধ্যে কোথাও রাখা হয় তাহা হইলে মহাদেব সেই স্থানেই অবস্থান নিবেন। রাবণ শর্তে মেনে নিলেন এবং মহাদেবকে কাধে করে নিয়ে রওয়ানা হলেন। যাত্রা পথে এই মৈনাক শিখরে এসে রাবণ মূত্রত্যাগ করার জন্য ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশধারী বিষ্ণুভক্ত নারদকে শিব লিঙ্গটি কিছুক্ষণের জন্য ধরতে বলেন। নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষার পর নারদ মুনি এটি মাটিতে রেখে অদৃশ্য হয়ে যান। প্রকৃতির কাজ সেরে রাবণ এসে সেই ব্রাহ্মণকে দেখতে পেলেন না। (জায়গাটি এখনও বিদ্যামান, যাহার নাম মুদিছড়া রূপে পরিচিত, এটি মন্দিরের এক কিলোমিটার পিছনে অবস্থিত। ) অবশেষে শিলারূপি মহাদেবকে কাধে উঠাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু সর্বশক্তি নিয়োগ করেও উঠাতে পারলেন না। উঠানো চেষ্টার চিহ্ন হিসাবে এই পাথরের উপর একটি চাপ পড়ে। যাহা এখনো বিদ্যামান। তখন দৈববাণী হল “রাবণ তোমার অমরত্ব লাভ ব্যর্থ হল, তুমি খালি হাতে লঙ্কায় চলে যাও। মহাদেব এই মৈনাক শিখরেই অবস্থান নিবেন’’। রাবণ লংকায় পৌছলেন, রামের সহিত যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পরাজয় বরণ করলেন।

মন্তব্যসমূহ